Pages

Finance and Travel Ideas

Saturday 8 December 2018

নয়ন।

নামটি তার নয়ন। যদিও তাকে কারো নয়নের মণি বলা যায় না, কিন্তু গ্রামসুদ্ধ লোক তাকে ভালোবাসে। অনেক ছোটবেলাতেই মা বাবাকে হারিয়েছে সে। গ্রামের লোকেরাই তার দেখভাল করেছে। লেখাপড়া তার খুব বেশিদূর হয়নি। কোনরকমে টেনেটুনে ক্লাস এইট। গ্রামে এর ওর ফাইফরমাস খাটে, দুপয়সা যা রোজগার হয়, চলে যায়। গ্রামের লোকেরাই একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

গ্রামের নাম গোবিন্দপুর (কাল্পনিক)। পশ্চিমবঙ্গের কোন একটি জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। নয়ন থাকে একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে। আজ থেকে বহু বছর আগে ওই কুঁড়েঘরে এক তান্ত্রিক এসে আশ্রয় গেড়েছিল। তান্ত্রিকেরা সাধারণত একজায়গায় খুব বেশিদিন থাকে না। একদিন সেও গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেল। তাই গ্রামের লোকেরা নয়নকে বলল, “কুঁড়েটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে, তুইই থাক ওখানে। তোর জন্য আলাদা ঘর করে দেওয়া অনেক খরচার ব্যাপার। পরে দেখা যাবে।“ নয়ন তাতেই রাজি হল। অন্ন বস্ত্রের জন্য তার চিন্তা নেই, বাসস্থানও সে পেয়ে গেল। গ্রামের লোকেরাই তার বিছানা, তোষক ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিল।

নয়নের বহুদিনের অভ্যাস অবসর সময়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো। এই করতে গিয়ে সে অনেক কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। তবে কোনটাই খুব ভীতিপ্রদ নয়।

একদিন সন্ধ্যেবেলা নয়নের হাতে কোন কাজ ছিল না। সে মাঝে মাঝেই ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের শ্মশানের কাছে চলে যেত। অন্য লোকেরা যেখানে শ্মশানকে এড়িয়ে চলে, সেখানে নয়ন নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। নির্জনতা যেন তাকে আকর্ষণ করত।

সে ঘুরতে ঘুরতে শ্মশানের কাছে এসে লক্ষ্য করল, ভিতরে একটা ধুনি জ্বলছে। এখন এইখানে কে ধুনি জ্বালাবে? আশেপাশে কাউকে তো চোখে পড়ছে না। আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক। একটা বড় গাছের আড়াল থেকে সে দেখল, ধুনির পাশে গেরুয়া বসন পরিহিত কে যেন বসে আছে। ধুনির ধোঁয়ায় যেন একটা আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। 

ধুনির পাশে বসে থাকা লোকটাকে একজন সাধুবাবা বলেই মনে হল তার। কিন্তু সাধুবাবার হাতে ওটা কি? ভালো বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু ঠাওর করে দেখতেই চমকে উঠল নয়ন। ওটা তো একটা কাটা মুণ্ডু, যার গলার কাছ দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত সাধুবাবার পায়ের কাছে একটা কঙ্কালের খুলির মধ্যে পড়ছে। সাধুবাবা আবার বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়ছেন। ভয়ে নয়নের গলা শুকিয়ে গেল।

খসখস পায়ের শব্দ হওয়াতেই মনে হয় সাধুবাবা নয়নের উপস্থিতি টের পেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নয়ন ভয়ে চুপ করে রইল, নট নড়নচড়ন না কিছু। কিন্তু সাধুবাবা তাকে কিছু বললেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নয়ন দে দৌড়, দেখতে দেখতে ত্রিসীমানা পার।

গ্রামে পৌঁছে নয়ন কাউকে কিছুই বলল না। কিন্তু তার মনটা খচখচ করতেই থাকল। এত বড় একটা বীভৎস ব্যাপার, চুপ করে থাকাটাও তো উচিত হবে না। নয়ন ভাবল কয়েকদিন অপেক্ষা করা যাক।



বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। গ্রামের মোড়লের কাছে খবর পৌঁছল যে আশেপাশের গ্রাম থেকে নাকি বেশ কয়েকটি বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে। চিন্তায় পড়ে গেল মোড়ল। নয়নও ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। সে খবরটা আর চেপে রাখতে পারল না। বলেই দিল মোড়লকে।

মোড়ল ব্যাপারটা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “যা দেখেছিস, ঠিক দেখেছিস? মনের ভুল নয়তো?” নয়ন বলল, “না গো মোড়লমশাই, আমি ঠিকই দেখেছি।“

মোড়ল বলল, ”ঠিক আছে, আরেকদিন তোর সঙ্গে আমি চুপিচুপি শ্মশানে যাব। দেখি ব্যাপারটা কি হচ্ছে। তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করব।“ নয়ন রাজি হল। একা যেতে হলে হয়ত সাহস পেত না, কিন্তু সঙ্গে মোড়ল থাকবে।   
এই কথামত একদিন সন্ধ্যেবেলা নয়ন মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে সাধুবাবার কাণ্ডকারখানা সব দেখে এল। সেদিন সাধুবাবা শবসাধনা করছিলেন। পাশে কারণবারিও রাখা ছিল। চারিদিকে একটা ভৌতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। তাদের দুজনের উপস্থিতি তিনি টের পাননি বা টের পেলেও তাদের বুঝতে দেননি। তার মনসংযোগ এতটাই বেশি ছিল।
দুজনেই চুপচাপ বাড়ি ফিরে এল। ফেরার পথে মোড়ল তাকে সাবধান করল, “এখনই কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। ভেবে দেখি কি করা যায়।“

রাত তখন বেশ গভীর। মোড়ল নিজের একচালা ঘরে শুয়ে রয়েছে। স্ত্রী অল্পবয়সে বিয়োগ হওয়াতে একাই থাকে, ছেলেমেয়ে হয়নি। সাধুবাবার এই কাণ্ডকারখানা নিয়ে একটু বেশীই চিন্তিত ছিল বলে ঘুম আসতে দেরিই হচ্ছিল। চোখটা যেন একটু বুজে এসেছে, মনে হল অস্ফুট স্বরে কেউ তার নাম ধরে ডাকল। গলাটা যেন চেনাচেনা লাগল তার। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। ওই আবার! কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। আরে! এতো তার স্ত্রী সরমার গলা। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সরমা তো কতদিন আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে কি অন্য কেউ? মোড়ল আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজাটা খুলে ফেলল। 

দরজাটা খুলে প্রথমে পরিষ্কার কিছু দেখতে পেল না। দূরে মনে হল আবছা একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে পা টিপে এগিয়ে চলল। সে যত এগোচ্ছে, ছায়ামূর্তিটাও যেন আরও দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। সে যেন এই ডাকে সম্মোহিত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে মোড়লের দেহটা জঙ্গলের গহীনে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দূরে যেন একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ।

পরের দিন গ্রামের লোকেরা দেখল মোড়লের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, মোড়ল বেপাত্তা। হইহই রব পড়ে গেল। একেকজনের একেকরকম মতামত। শুধু নয়নই চুপ করে রইল। সে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। তবুও সে কাউকে কিছু জানাল না। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে......

মোড়ল নিখোঁজ হবার পর এক সপ্তাহ মত কেটে গেছে। তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। সেদিন রাতের কথা। নয়ন শুয়ে রয়েছে কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মোড়লের কথাটা তার বারবার মনে আসছে। তাকে খুবই ভালবাসত, নিজের সন্তানের মতই দেখত। তার যেকোনো সমস্যার সমাধান মুহূর্তের মধ্যে করে দিত। তার কি হল? তাকে কি সাধুবাবা খুন করেছে? কেনই বা তা করতে যাবে? মোড়লের কোন শত্রু ছিল বলে তার মনে পড়ল না। এমনি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু যেন ঘুমঘুম ভাব এসেছে, হঠাৎই যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকল।

“এই নয়ন!”

চমকে উঠল সে। আরে! এতো পরিষ্কার মোড়লের গলা। তবে কি মোড়ল ফিরে এসেছে? কিন্তু এতদিন ধরে যে লোকটা নিখোঁজ সে হঠাৎ তার কাছে এসেছে কেন? সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।

“এই নয়ন, বাইরে আয়, আমি মোড়লমশাই বলছি!”

নয়নকে কেমন যেন একটা অজানা ভয় গ্রাস করতে থাকে। হঠাৎই তার নিশির ডাকের কথা মনে পড়ে যায়। এ নিশ্চয় নিশির ডাক হবে। ওই সাধুবাবারই কীর্তিকলাপ এটা। সে নিশ্চয় নিশির ডাক ব্যবহার করে কোনভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এবারে তার মনে হল বহু বছর আগে যে তান্ত্রিক এ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছিল এই সাধুবাবা সে ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তার ফাঁদে পা দিয়েই নিশ্চয় মোড়ল প্রাণ হারিয়েছে এবং নিশিতে রুপান্তরিত হয়েছে। এবারে তার পালা। না, সে কিছুতেই এই ডাকে সাড়া দেবে না। মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়।   

“এই নয়ন, বাইরে আসবি তো, আমি মোড়লমশাই বলছি!”

আবার সেই ডাক! নয়ন উঠল না। আর ডাকাডাকি শোনা গেল না। বাকি রাতটা নয়ন জেগেই কাটিয়ে দিল।
পরের দিন সকালে নয়ন একটা খুব গুরুতর সিদ্ধান্ত নিল। সাধুবাবাকে সে নিজের হাতে শেষ করবে। হ্যাঁ, নিজের হাতে। এর জন্যে হয়ত তাকে খুব বড় একটা ঝুঁকি নিতে হবে, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। মনে মনে ঠিক করে ফেলল কি করবে। গ্রামের পুরানো ভাঙা কালীমন্দির থেকে ত্রিশূলটা জোগাড় করতে হবে। চুপিসারে কাজটা সারতে হবে, কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়।

দুপুরের দিকে গ্রামের রাস্তা মোটামুটি নির্জন হয়ে যায়। কাউকে জানান না দিয়ে নয়ন ত্রিশূলটা জোগাড় করে ফেলল। মনে মনে মা কালীর আশীর্বাদও কামনা করল।

সেই রাতটা ছিল বর্ষাবাদলের রাত। নয়নের বুকটা দুরদুর করছিল, কিন্তু সে মনে সাহস সঞ্চয় করল। ধীরে ধীরে সে শ্মশানের দিকে এগোতে থাকল। কারো চোখে পড়ে গেলে পুরো ব্যাপারটাই পণ্ড হয়ে যাবে।

অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে তার দৃষ্টিটা মাঝেমধ্যে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, তবুও নয়ন থামছে না। শ্মশানের কাছে এসে সে চলার গতিটা কমিয়ে দিল। একটা গাছের আড়ালে এসে দাঁড়াল। সেখান থেকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে সাধুবাবার উপস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করল। ওই, ওইতো দূরে একটা ছাউনির তলায় ধুনি জ্বালিয়ে শয়তানটা বসে রয়েছে। নাহ, এতো দূর থেকে কিছু করা যাবে না। আরেকটু কাছে যেতে হবে। আশপাশে একটু ঝোপঝাড় আছে, তার আড়াল দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করা যাক। প্রায় সে ছাউনিটার কাছে এসে পড়েছে, হঠাৎ দেখল সাধুবাবা ছাউনিতে নেই। গেল কোথায় লোকটা?

কড়কড় কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ল। এতটাই আকস্মিক যে নয়ন চমকে উঠল। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। তাকে যেন কতগুলো ছায়ামূর্তি ঘিরে ফেলছে চারদিক থেকে। গোঙানির মত শব্দটা যেন তারাই করছিল। আরেকটু কাছে আসতে বুঝতে পারল তাকে ঘিরে ধরছে কতগুলো পচাগলা মৃতদেহ। পাগুলো যেন তারা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটছে। প্রত্যেকের ডান হাতে তাদের মুণ্ডুগুলো ঝুলছে। সেগুলো যেন বিস্ফারিত চোখ মেলে নয়নের দিকে চেয়ে আছে। কি চায় ওগুলো? 

আচমকা নয়নের সামনে আবির্ভূত হল সাধুবাবা। জলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “এবার তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। একদম মৃত্যুর মুখে এসে পড়েছিস তুই!“

নয়নের মুখে কথা সরছে না।

“তুই আমার অমরত্বের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছিস। তোর সঙ্গে মোড়লও ছিল। ওকে তো আমি নিশি বানিয়েইছি। তোকেও বানাব।“

নয়ন কোনরকমে তার পিঠে লুকিয়ে রাখা ভাঙা ত্রিশূলটা অনুভব করল। সময় এসে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। সাধুবাবা তার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেই সে প্রানপনে ত্রিশূলটা বার করে সাধুবাবার বুক লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই যেন কড় কড়াত শব্দে আরেকটা বাজ পড়ল। চারদিক যেন রুপোলী আলোয় ভেসে গেল মুহূর্তের জন্য। সেই আলোয় ক্ষণিকের জন্য নয়ন দেখল সাধুবাবা বুকে বিঁধে থাকা ত্রিশূলটা চেপে ধরে চিত হয়ে পড়ে গেল, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ভেজা মাটিকে আরও সিক্ত করে দিচ্ছে। তাকে ঘিরে ফেলেছিল যে ভয়াবহ মূর্তিগুলো, সেগুলো যেন আবছা হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। নয়ন জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল।

কে যেন তাকে নাম ধরে ডাকছে। নয়ন আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তাকে ঘিরে গ্রামের প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার একেবারে কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বসন্তকাকা, তার ঘরের কটা বাড়ি পরেই থাকে, তাকে ছেলের মতই ভালোবাসে। বসন্তকাকা বলে উঠল, “তুই আমাদের খুব বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিস। আশেপাশের গ্রামে যত ছেলেপিলে নিখোঁজ হয়েছিল, সব এই সাধুবাবারই কীর্তি। কিভাবে যেন তুক করে ওদের নিয়ে এসে বলি দিত। কি ছাইপাঁশ অমরত্বের ব্রত নিয়েছিল, সেই জন্যই নাকি এসব করত। তোকে ভোরবেলা বাড়িতে না দেখে খুঁজতে খুঁজতে এদিকপানে এসে তোকে এই অবস্থায় পেলাম।“ নয়ন আস্তে আস্তে উঠে বসল। গ্রামের লোকেরা তার নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। শুধু মোড়লের কথাটা মনে পড়তেই নয়নের চোখের কোণায় একটু জল চলে এল।

Thursday 8 November 2018

আমার লেখা দুটি কবিতা।

১) চেষ্টা। #অণুকবিতা

ভুতের গল্প লেখার চেষ্টা আমি করি মাঝে মাঝে
যখনই অল্পবিস্তর সময় পাই সকাল সাঁঝে
প্রশংসা যে সবসময় জোটে তা নয় বটে
তবুও লেখক হিসাবে নাম করার ইচ্ছা আছে।
ফেসবুকেতে পোষ্টাই, ব্লগও লিখি অবসরে
যখন দেখি কমেন্ট বা লাইক, মনটা আনন্দে ভরে
সাহিত্যিক বন্ধুরা উৎসাহ দিতেই থাকে
লেখার চেষ্টা আমি চালিয়েই যাব নিরন্তরে।



২) সাইকেল বিভ্রাট।

বুড়ো বয়েসে কিনেই ফেললাম একটা সাইকেল
এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই সকাল বিকেল
বাজার হাট সবই করি, ছাত্র পড়াতেও ছুটি
বড়ই কাজের জিনিস, এই ভেবে হই উদ্বেল।

একদিন ফিরছিলাম বাড়ি চড়ে সেই সাইকেল
ঘেউ ঘেউ শুনে যেন হয় হার্ট ফেল
ঘিরে ফেলেছে গোটা তিন কুকুরে
যেন কামড়াবেই আমাকে, খতম আমার খেল।

বাধ্য হয়ে জুড়লাম “এই, এই” চিৎকার
টাল সামলাতে না পেরে খেলাম আছাড়
হঠাৎ দেখি একজন উদয় হলেন
জোর ধমকে করলেন কুকুরগুলোকে পগারপার।

সেই থেকে আমি করেছি অঙ্গীকার
অসাবধানে সাইকেল চালাব না আর 
যতই তাড়া থাকুক না কেন
সামনে কুকুর পড়লে সাইকেল থামাব বারবার।

Tuesday 16 October 2018

কাজলদিঘির অপদেবতা।

গ্রামের নাম নিশ্চিন্দিপুর। খুবই সুন্দর একটি গ্রাম, পাহাড়ের কোলে সবুজিমা দিয়ে ঘেরা। গ্রামে চার পাঁচশ লোকের বাস। শান্তিতেই বসবাস করছিল সব, কোন ঝুটঝামেলা নেই। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে গ্রামে শুধু একটাই সমস্যা, আর সেইটা কাজলদিঘি সম্পর্কিত।

এই প্রসঙ্গে কাজলদিঘির ব্যাপারে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। এটি বহু বছর আগে খোঁড়া একটি মনুষ্যসৃষ্ট দিঘি। দিঘির আয়তন বিশাল, এপার থেকে ওপার হতে বেশ সময় লাগে। দিনের বেলা লোকে মাছ ধরে, সাঁতার কাটে, কোন ভয়ের ব্যাপার নেই। কিন্তু রাতের বেলা ওই পানে যাওয়া বারণ। কেন?

শোনা যায়, বহু বছর আগে গ্রামে এক বিধবা মহিলা বাস করত। তার নাম ছিল রেবা। সুতো কেটে, কাপড় সেলাই করে দিন গুজরান করত। খুবই অভাবের মধ্যে সংসার চলত। হঠাৎই একদিন রাতে সে নিখোঁজ হয়ে গেল। পরের দিন সকালে কাজলদিঘিতে তার দেহটা ভেসে ওঠে। শরীরটা জল খেয়ে ফুলে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে বিস্ফারিত। আত্মহত্যা না খুন, কিছুই জানা যায় না। কিছু দিন পর ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল।

এই ঘটনার পর থেকেই কাজলদিঘিতে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে থাকে এলাকার মানুষজনেরা। রাত্রিবেলা স্ত্রীলোকের গলায় কান্নার আওয়াজ অনেকেই নাকি শুনতে পায়। এলাকায় একবার ভুমিকম্প হয়। এলাকায় অন্যান্য যে দিঘিগুলি রয়েছে, সেগুলোর জলে কম্পন তো দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কাজলদিঘির জল যেন এপাশ ওপাশ হচ্ছে। এইরকম আলোড়ন খুব কমই দেখা যায়। অন্য দিঘিগুলোর জল স্থির হয়ে যাবার পরেও যেন কাজলদিঘির জল যেন থির থির করে কাঁপছিল। এলাকার লোকজন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই ঠিক করল যে পাশের গাঁয়ের রামেশ্বর গুণিনের শরণাপন্ন হবে।

রামেশ্বর গুণিন বাকসিদ্ধ এবং তন্ত্রসিদ্ধ গুণিন। চার পাঁচটা গ্রাম মিলিয়ে তার খুব নামডাক। ঝাড়ফুঁক, ভূত তাড়ানো, বাণ মারা, অপদেবতা থেকে মুক্তি, সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। অতএব তাকেই ডাকা হল। সবকিছু শুনে সে কিছুক্ষণ গাঁজায় দম দিয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর “বোম ভোলে! হর হর মহাদেব!” হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, “এখানে নৃমুণ্ডমালিনীর পূজা দিতে হবে। নইলে তোদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।“ সবাই রাজি হল। কিন্তু গুণিন এই সাবধান বাণীও দিল যে পর পর অন্তত তিন বছর এই পূজা চালিয়ে যেতে হবে। কোন বছর যদি পূজা বন্ধ থাকে, তাহলে বিপদ আবার ফিরে আসবে।

রামেশ্বর গুণিনের কথামত ষোড়শ উপচারে শ্মশান বিহারিণী দেবীর পূজার ব্যবস্থা হল। কিন্তু শবদেহের কি ব্যবস্থা হবে? ঠিক হল গ্রামের নিকটবর্তী শ্মশান থেকেই শবদেহ আনা হবে। পর পর দুবছর ঠিকঠাক পূজা সম্পন্ন হল। কিন্তু তৃতীয় বছরে একটা সমস্যা দেখা দিল। শ্মশান যে জমিতে ছিল, সেটা নাকি বিতর্কিত। জমির মালিক নাকি মামলায় জিতে জমির দখল নিয়ে কারখানা না কি করবে। অতএব কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী শ্মশান সরিয়ে নেওয়া হল। এবারে শবদেহ জোগাড় করাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোথাও শবদেহ পাওয়া গেল না। অভিসম্পাত করতে লাগল গুণিন। সেবছর পূজা আর হল না। তারপর একদিন রামেশ্বর গুণিনও ভোজবাজির মত গ্রাম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল, কেন গেল কেউ বলতে পারল না। তাকে সেই গ্রামে আর কেউ কোনদিন দেখতে পায়নি।

সবার মনেই শঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে এল। কাজলদিঘির আশেপাশে রাত্রিবেলা আবার শোনা যেতে লাগল নানারকম পৈশাচিক আর্তনাদ। সবাই জায়গাটা এড়িয়ে চলতে শুরু করল।

মনসুখ পাণ্ডে জন্মসূত্রে বিহারী, কিন্তু বহুবছর ধরে সে নিশ্চিন্দিপুরে বাস করছে। বাজারের কাছে তার একটা পানের দোকান আছে। প্রত্যেকদিনই সন্ধ্যে সন্ধ্যে সে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে, কিন্তু সেদিন একটু বিক্রিবাট্টা ভালো ছিল বলে যেন একটু বেশীই দেরি হয়ে গেল। যাই হোক, দোকানপাট বন্ধ করে সে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। বিক্রি ভালো হওয়াতে বেশ খোশ মেজাজ, একটা দেহাতি গান গুনগুন করতে করতে সে চলতে লাগল।     

মনসুখের বাড়ি ফেরার দুটো পথ আছে। একটা ঘুরপথ, বেশি সময় লাগে, কিন্তু ওই রাস্তায় কাজলদিঘি পড়ে না। আরেকটা কাজলদিঘির গা ঘেঁসেই, সেটা শর্টকাট হয়। মনসুখ ঠিক করল রাত হয়ে গেছে, শর্টকাট রাস্তাই ধরবে। জায়গাটার ইতিহাস তার খেয়ালই ছিল না। তাহলে হয়ত ওই রাস্তাটা সে বেছে নিত না।   



কাজলদিঘির ঠিক ধারেই একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনসুখের যেন মনে হল ফিসফিসিয়ে তার নাম ধরে কেউ ডাকল। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভাবল মনের ভুল। ভুল করে টর্চটাও দোকানে ফেলে এসেছে। পকেটে একটা দেশলাই বাক্স ছিল। বার করে দুএকটা কাঠি জ্বালাল। চারদিকে ভাল করে দেখল। নাহ, কেউ নেই। একটু এগিয়ে আবার সেই ডাক শুনল। এবার নজরটা শ্যাওড়া গাছের ওপর পড়ল। গাছের ওপরদিকের একটি ডালে যেন কেউ বসে আছে। আলো আধারিতে ভালো বুঝতে পারল না। মেয়েমানুষই মনে হল। কিন্তু এতরাতে গাছের ওপর সে কি করছে? একটু ভয়ও পেল, কৌতূহলও হল। দূর থেকেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনি? এত রাতে গাছের উপর কি করছেন?” মূর্তিটার কোন হেলদোল নেই। পা টিপে টিপে আরেকটু এগিয়ে গেল। এইবারে যা দেখল তাতে তার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল।

মনসুখ দেখল গাছের ডালে বসে তার দিকে চেয়ে রয়েছে একটি কঙ্কাল যার গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো। তার নরকরোটির দুটি চোখের গহ্বরে যেন আগুনের গোলা জ্বলজ্বল করছে। কঙ্কালটি যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। বীভৎস দন্তবিকশিত হাসিও যেন একঝলক দেখা গেল। ভয়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে মনসুখের ডান পাটা একটা গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তে যেন নরম কাদার মধ্যে তার পাটা ঢুকে যেতে লাগল। ভর দিয়ে পাটাকে বার করতে গিয়ে কেমনভাবে যেন অপর পাটাও গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তটা যেন একটা সুড়ঙ্গের মত, তার শরীরটাকে আস্তে আস্তে টেনে নিচ্ছে। গায়ে যেন জলের ঝাপটাও লাগছে। তাকে কি কেউ দিঘির নিচে টেনে নিচ্ছে? শরীরে যেন ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে মনসুখ। দম আটকে আসছে। তাকে কেউ যেন সাঁড়াশি দিয়ে পিষে ধরছে। শেষ মুহূর্তে কংকালের বিকট দংষ্ট্রাবিকশিত হাসি যেন দেখতে পেল মনসুখ। জলের উপরিভাগে কিছুক্ষণ আলোড়ন, হয়ত মনসুখেরই ছটপটানির ফলশ্রুতি, তারপর কিছু বুদবুদ ভেসে উঠল। তারপর দিঘির জল একদম স্থির।

পরের দিন সকালে গাঁয়ের মেয়েরা কাজলদিঘির পারে মনসুখের মৃতদেহটা আবিষ্কার করল। মনসুখ একাই থাকত, তাই রাতে তার জন্য কেউ খোঁজখবর করে নি। শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু কেউই কোন উপায় বাতলাতে পারল না এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার। গ্রাম পঞ্চায়েতের সভা ডাকা হল। আলাপ আলোচনার পর স্থির হল, আর কিছুদিন দেখা যাক। তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা আবার ঘটলে ওই দিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দিতে হবে। আপাতত রাত্রিবেলা ওই পথ কেউ যেন কোনভাবেই না মাড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হল।

কথায় আছে, ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না। সতর্ক করে দিলে কি হবে, ক্ষণিকের অসাবধানতায় বড় বিপদ ঘটে যেতেই পারে। গ্রামে চৌধুরীদের বাড়ির ছেলে সাগরেরও ঠিক তাই হল। সাগরের মায়ের এবং তার মাসির এই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। দুজনের শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। গ্রামে ডাক্তার বদ্যির খুব সমস্যা। সামান্য জ্বরজারি হলেই পাশের গাঁয়ে ছুটতে হয়। সাগরের মার একদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। সাগরের বাবা পড়ল মহা চিন্তায়। হঠাৎই তার মনে পড়ল সাগরের মাসির বর অল্প কবিরাজি বিদ্যা জানে, টুকটাক জ্বরজারির চিকিৎসাও করে থাকে। এত রাতে আর সাগরকে পাশের গাঁয়ে না পাঠিয়ে ওই বাড়িতে পাঠানোই সমীচীন হবে। সে সাগরকে ডেকে বলল, “বাবা সাগর, তোর মেসোমশাইয়ের কাছে এক ছুটে চলে যা। মার কথাটা বল। দেখ কিছু ওষুধ পথ্যির ব্যবস্থা দিতে পারে কিনা। আমি ততক্ষণ তোর মার জন্য জলপটির ব্যবস্থা করিগে।“ সাগর মা অন্ত প্রাণ, শুনেই মারল এক দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে খেয়ালই নেই সে কাজলদিঘির কাছে এসে পড়েছে। হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারিদিকে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

তার দিঘির ওপর চোখ গেল। অদ্ভুত একটা নীল নীল আলো খেলে বেড়াচ্ছে। আলেয়া? হবে হয়ত। আচমকা সে মহিলার গলায় এক তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেল। তার গা ছমছম করে উঠল। তাড়াতাড়ি এই জায়গাটা থেকে বেরোতে হবে। এই জায়গাটা অশুভ। কয়েকপা এগিয়েই দেখল সামনে একটা ডোবা। একি? এখানে তো আগে ডোবা ছিল না। অন্যদিকে যেতে গিয়ে আবার কয়েকপা ফেলে দেখে আরেকটা ডোবা। চারদিক যেন ডোবায় ভর্তি হয়ে গেছে। কি যে হচ্ছে, তার বোধগম্য হল না। পায়ে পায়ে কারা তার দিকে এগিয়ে আসছে? খনখনে গলায় কে যেন হেসে উঠল। সাগরের হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চারদিক থেকে নরকঙ্কালের দল তাকে ঘিরে ধরতে আসছে। তার মনের মধ্যে কে যেন আকুলিবিকুলি করে উঠল, “পালা, সাগর, পালা।“ কিন্তু পালাবে কোনদিকে? কঙ্কালের হাত থেকে বাঁচতে হলে তাকে দৌড়াতে হবে। কিন্তু যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই ডোবা। যা থাকে কপালে ভেবে মারল ঝাঁপ সামনের ডোবাটায়। জল একদম কনকনে ঠাণ্ডা। পায়ে যেন লতার মত কি জড়িয়ে যাচ্ছে। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, লতাগুলো যেন সাপের মত কিলবিল করে তার গলার দিকে এগিয়ে আসছে। পিচ্ছিল লতার স্পর্শ তাকে ভয়ার্ত করে তুলল। লতাগুলো তার গলায় চেপে বসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। শেষে এইভাবে তাকে মরতে হবে? তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল মায়ের অসুস্থ মুখের ছবিটা, যাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে এল। অতল জলের গহ্বরের আকর্ষণে যেন সে মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে সাগরের দেহটা দিঘি থেকে উদ্ধার হল। কোনভাবে সে দিঘিতে নেমেছিল আর পায়ে লতা জড়িয়ে যাওয়ায় আর উঠতে পারেনি। রাতেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সে যে এই পথে আসবে, কেউ ভাবেনি আর সাহসও করেনি। গ্রামবাসীরা আর কোন ঝুঁকি নিল না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজলদিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হল। এই দিঘির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি।

Saturday 6 October 2018

কুহকিনীর মায়া।

চলন্ত ডাউন বারুইপুর লোকালে বসে কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎই সামনের সিটের কোনার দিকে নজর পড়ল রজতের। একটি মেয়ে বসে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। এমনিতে রজতের চেহারাটা বেশ সুপুরুষ, রাস্তায় চলতে ফিরতে অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু এই ব্যাপারটা যেন একটু অন্যরকম। মেয়েটির চোখে যেন পলক পড়ছে না। চোখ সরিয়ে কিছুক্ষণ কাগজের দিকে মন দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখল একই ব্যাপার। স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি সালওয়ার কামিজ পরে রয়েছে, মাথায় ওড়নাটা হালকা ঢাকা দেওয়া আছে কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে। অপূর্ব সুন্দরী না হলেও একটা আকর্ষণ আছে। কিন্তু চাউনিটা যেন কেমন। গা ছম ছম করে উঠল তার। এরকম অভিজ্ঞতা তার কোনদিনই হয়নি। জোর করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। তার স্টেশন আসাতে নেমেও গেল। একটু অন্যমনস্ক ছিল, অনেক ভিড়ের মধ্যে সেই মেয়েটিও নামল কিনা খেয়াল করতে পারল না। মন থেকে ব্যাপারটাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করল।

কিন্তু পরের দিনও রজতের একই অভিজ্ঞতা হল। মেয়েটি ঠিক তার সামনের সিটে বসে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। ব্যাপারটা কি? মেয়েটি কি তাকে চেনে? তাকে কি কিছু বলতে চায়? ডেকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারে, এমন অস্বস্তিকর ভাবে চেয়ে থাকার মানেটা কি? রজতের মনের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। 

পর পর বেশ কয়েকদিন তার এই অভিজ্ঞতা হয়। অফিসে, বাড়িতে, কাজে, কর্মে সব জায়গায় রজত যেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। এমনিতে সে খুব মিশুকে নয়, কিন্তু অফিসে অনিলই এমন একজন যার সঙ্গে সে নিজের সুখ দুঃখের কথা একটু আধটু ভাগ করে নেয়। একদিন সে বলেই ফেলল কথাটা। 

“জানিস অনিল, প্রত্যেকদিন অফিস থেকে ফেরার ট্রেনে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।“
“সে কি রে? কিরকম শুনি?”
“একটা মেয়ে সামনের সিটে বসে আমার দিকে রোজ তাকিয়ে থাকে।“
“তাই নাকি? তা এতে অদ্ভুত কি আছে? তুই এত সুপুরুষ, হয়ত তোকে ভালো লেগেছে।“
“ব্যাপারটা এতো মজার নয় রে। মেয়েটার চাউনি যেন কেমন। আমার অস্বস্তি লাগে।“
“কেন? কি রকম চাউনি?”
“সে তোকে বলে বোঝানো যাবে না।”
রজত চুপ করে যায়। অনিলও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি আর ঘাঁটায় না, নিজের কাজে মন দেয়।

আরও দুচার দিন এই ভাবে চলে। একদিন ট্রেনটা যেন একটু বেশিই ফাঁকা ছিল। মেয়েটি একদম তার সামনে এসে বসে পড়ল। রজত একটু চমকে উঠল। কিন্তু মনে মনে সে স্থির করল যে আজ সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবেই। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের জড়তাটা কাটিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “শুনুন, কিছু যদি মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”
“হ্যাঁ, বলুন।“
“আপনি কি আমাকে কোনভাবে চেনেন? বা আগে কোথাও দেখেছেন?”
“কই, না তো।“
“তাহলে আপনি......আমার দিকে দেখি রোজই তাকিয়ে থাকেন?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।“
রজত চমকে উঠল। কি বলবে বুঝতে পারল না। একি মেয়েরে বাবা! সেদিন আর কথা এগোল না।


এরপর কয়েকদিন ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে আরও কিছু কথা হল মেয়েটির সঙ্গে। আস্তে আস্তে রজতও সহজভাবে কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে লাগল। ধীরে ধীরে তার অস্বস্তি কাটতে লাগল। যদিও সে কখনো প্রশ্ন করেনি তাকে কেন মেয়েটির খুব ভালো লাগে।

কথায় কথায় অনেককিছুই সে জানতে পারল মেয়েটির সম্বন্ধে। তার নাম মোহিনী, সে একটি সওদাগরী অফিসে রিসেপশনিস্টের কাজ করে। বাবা মা সে ছোট থাকতেই মারা গেছেন, মামাবাড়িতেই মানুষ। বারুইপুরে সে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে কারণ মামাবাড়িতে থাকার জায়গার খুব সমস্যা। মোহিনীও রজতের সম্পর্কে সবই জেনে নিয়েছে। বাবা মার একমাত্র ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা, উজ্জল ভবিষ্যৎ। কোম্পানিতে তার পদোন্নতি চোখে পড়ার মত। তরতরিয়ে উপরে উঠছে। কিছুদিনের মধ্যে রজতেরও মোহিনীকে ভালো লাগতে শুরু করল। 

এইরকম ভাবে চলছে। একদিন হঠাৎ মোহিনীই প্রস্তাবটা দিল, “চল না, একদিন ভিক্টোরিয়া, ময়দান এসব জায়গা ঘুরে আসি।“ রজত দেখল প্রস্তাব মন্দ নয়। প্রেম করার পক্ষে বেশ ভালো জায়গা এগুলো। এক রবিবার ঠিক হল যাওয়া। সময়টা বেশ কাটল দুজনের। ফেরার পথে একটা বেশ নামকরা রেস্তরাঁতে খেয়েও নিল দুজনে। কিন্তু যখন ট্যাক্সি করে ফিরছে সন্ধেবেলা, তখনই রজতের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

সেদিন মনে হয় পূর্ণিমা ছিল, আকাশে চাঁদটা থালার মত ঝলমল করছিল। ট্যাক্সিতে বসে রজত অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে মোহিনীর কোন ছায়া পড়ছে না। আর চাউনিটাও যেন কেমন অস্বাভাবিক। বাড়ি ফিরে সে এই ঘটনাটা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ল। তবে কাউকে কিছু জানাল না।

অনেকদিন ধরেই মোহিনী বায়না করছিল যে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কোথাও আউটিংএ যাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সেদিনের সেই ট্যাক্সির ঘটনা ঘটার পর রজতের খুব একটা উৎসাহ নেই। এদিকে মোহিনীরও প্রচণ্ড জেদ, যেতেই হবে। অগত্যা রজত রাজি হয়েই গেল। যদিও মনের ভিতরটা খচখচ করতেই লাগল।

দুজনে মিলে মন্দারমণিই ঠিক করল। বেশ নিরিবিলি জায়গা, বেড়ানোর পক্ষে বেশ ভালো। মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনেই রওনা দিল। ট্রেনে মন্দারমণি যেতে গেলে কাঁথিতে নামতে হয়, সেখান থেকে আবার গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বেশ ভালো একটা হোটেলে বুকিং করাই ছিল, সি ফেসিং একটা ঘর পাওয়া গেল। দিনের বেলা বেশ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে কেটে গেল সময়টা। কিন্তু রাত্রিবেলা যে ঘটনাটা ঘটল সেটা যেকোনো মানুষের মনকে বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুজনেই হোটেলে বেডরুমে এসে শুয়েছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রত্যেকদিনই রজতের বই পড়া অভ্যেস। এদিন সে ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” পড়ছিল। হঠাৎই মোহিনী তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস কর?”
“নাহ, তবে পড়তে ভালো লাগে এই আর কি।“
“ওঃ।“
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার প্রশ্ন করল, “যদি তুমি সামনাসামনি ভ্যাম্পায়ার দেখো, তোমার কেমন লাগবে?”
রজত চমকে উঠল। এই রকম প্রশ্ন সে আশা করেনি। মোহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখল কেমন যেন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরের বাইরেও আবহাওয়াটাও যেন পরিবর্তিত হচ্ছে। ঠাণ্ডা একটা হিমেল হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। মোহিনী হঠাৎই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে “যত্তসব বাজে কথা” বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল রজত। বইটা রেখে আলোটা নিভিয়ে দিল। আজ আর তার কিছু ভালো লাগছেনা।

কিন্তু মাঝরাতে যখন মোহিনী তাকে কাছে টেনে নিল, তার মধ্যে কামনার প্রবৃত্তি জেগে উঠল। সবই ঠিকঠাক ছিল, শুধু মোহিনীর শরীরটা তার যেন অসম্ভব শীতল মনে হল। এই প্রথম তাদের দৈহিক সম্পর্ক, কিন্তু রজত যেন সম্পূর্ণভাবে তা উপভোগ করতে পারল না। নিজেকে তার যেন একটা যন্ত্র বলে মনে হল।

মিলন শেষে রজত এলিয়ে পড়েছিল। শরীরটা যেন নিস্তেজ। হঠাৎই দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজাটা খুলে গেল। চমকে উঠে পাশ ফিরতেই দেখল মোহিনী পাশে নেই। গেল কোথায়? হঠাৎই বারান্দার দিকে নজর গেল। বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে? মোহিনী না? কিন্ত এ কোন মোহিনী? তার দেহটা যেন স্বচ্ছ, তার মধ্যে দিয়ে দুরের আকাশ, চিকচিকে তারা দেখা যাচ্ছে। মোহিনী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। কিন্তু রজত কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিন্তু মন্ত্রের মত যেন তাকে মোহিনী টানছে। সে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোহিনী তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু এই জড়ানো যেন প্রেমিকার আলিঙ্গন নয়। এ যেন অজগরের আলিঙ্গন। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সে চিৎকার করতে গেল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না। তার গোটা শরীরটা যেন বরফ জলে ডুবে যাচ্ছে। মোহিনীর লিপস্টিকে রাঙা সুন্দর দুটি ঠোঁটের পাশ দিয়ে ভয়াল একজোড়া ছুঁচলো দাঁত বেরিয়ে আসছে কেন? এরকম কি কোন স্বাভাবিক মানুষের হয়? এক ঝাঁকুনি দিয়ে রজতের গলাটা তার দিকে টেনে নিয়ে মোহিনী দাঁত বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তা দিয়ে মোহিনী যেন কতদিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। রজতের শরীরটা যেন খাঁচায় পোরা পাখির মত ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। তাকে পালকের মত তুলে নিয়ে হোটেলের তিনতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মোহিনী। সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজেই হয়ত নিচে পড়ার আওয়াজটা চাপা পড়ে গেল। জিঘাংসা ভরা দৃষ্টিতে নিচে একবার তাকিয়েই মোহিনী ধোঁয়ার মত বাতাসে মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে হোটেলের এক কর্মচারী রজতের মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। চোখদুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। শরীরটা যেন রক্তশূন্য কাঠের মত পড়ে রয়েছে। কেউ যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। গলার বাঁদিকে দুটো গোল সমান্তরাল ক্ষতচিহ্ন। আস্তে আস্তে তার চারপাশের ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। পুলিশকে খবর দিতে হবে।

Sunday 23 September 2018

বিভূতিভূষণের জীবনের সত্য ঘটনা।

"বিভূতিভূষণের বৈঠকি গপ্পো" থেকে প্রাপ্ত। একটু ছোট করে লিখলাম। এইটা ঘাটশিলার কাছে সুবর্ণরেখা নদীর পারে ঘটেছিল। বিভূতিভূষণ পুজোর ছুটিতে ঘাটশিলা ভ্রমণে গেছিলেন। প্রায়ই সেখানে যেতেন কারণ তাঁর ছোট ভাই নুটুবিহারী সেখানে হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। বিভূতিভূষণ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক আর ঘাটশিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা কে না জানে। আর উনি ছিলেন অত্যন্ত আলাপী মানুষ, অল্প সময়ের মধ্যেই লোকজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলতেন।

এমনি এক সন্ধ্যায় সবান্ধব বেড়াতে বেড়িয়েছিলেন। দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেল, তাঁর বাড়ি ফেরার নাম নেই। বাড়ির লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ল। রাত দশটা বেজে গেল, তাই বাধ্য হয়েই ভাই নুটুবিহারী খোঁজ করতে বেরলেন। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারল না। হঠাৎই বিভূতিভূষণ সবার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বাড়ি ফিরলেন। দুজন বন্ধু তাকে আলো নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। সবারই প্রচণ্ড কৌতূহল, কি হয়েছিল। খেতে বসে ঘটনাটা বর্ণনা করলেন।   

হাঁটতে হাঁটতে সুবর্ণরেখার ধার ধরে অনেকদুর চলে গেছিলেন। পূর্ণিমার রাত। শ্মশানঘাটের কাছে পৌঁছে গেছেন সবাই। হঠাৎ করে তাঁর মনে হল যেন দূরে একটা খাটিয়ায় শায়িত শবদেহ দেখতে পেলেন। অথচ তাঁর সঙ্গে যারা ছিলেন তারা তা দেখতে পেলেন না এবং বিভূতিভূষণের কথা বিশ্বাসও করলেন না। মনের ভুল বলে উড়িয়েই দিলেন। শুধু তাই নয়, বাড়ি ফেরার তাগাদা লাগালেন। রাত্রিবেলা শ্মশানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভাল, এই যুক্তিও দিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বিভূতিভূষণের অলৌকিক ব্যাপার জানার অদম্য কৌতূহল ছিল। এত সহজে তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন। কিন্তু সঙ্গীরা তাকে একা কিছুতেই ছাড়বেন না। অগত্যা তাদের পিছন পিছন সাঁওতাল পাড়ার কাছে এসে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সঙ্গীদের বললেন যে লোকালয় প্রায় এসেই গেছে, তারা এগিয়ে যান, তিনি একটু পরে যাচ্ছেন। সঙ্গীরা রাজি হলে তিনি লম্বা লম্বা পায়ে আবার শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দেখলেন সত্যিই একটা শবদেহ সমেত খাটিয়া পড়ে রয়েছে। কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে দেখলেন শবদেহটা একটা ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে ঢাকা আছে। আশেপাশে কেউ নেই। শবযাত্রীরা এদিক ওদিক কোথাও গেছে ভেবে হাঁকডাক করলেন, কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। হঠাৎ তাঁকে কেউ যেন বলল "যা না...... কাঁথাটা সরিয়ে দেখ।" বিভূতিভূষণ শিউড়ে উঠলেন। পিছন দিকে তাকালেন কিন্তু কণ্ঠস্বরের অধিকারীকে দেখতে পেলেন না। ভাবছেন পালাবেন কিনা। কিন্তু কৌতূহল সম্বরণও করতে পারলেন না। আবার সেই রহস্যজনক কণ্ঠস্বর, "যা, যা না, এগিয়ে যা...... কাঁথাটা সরিয়ে দেখ।" তাকে যেন কোন অলৌকিক শক্তি শবদেহটার দিকে টানছে। কাঁথাটা সরিয়ে দেখলেন একজন বয়স্ক পুরুষের মৃতদেহ। বড় বড় চোখ মেলে তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছে মনে হল। আরও কাছে মুখ আনতেই ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। মৃতদেহটার মুখাবয়ব একদম তাঁর মতন - অবিকল এক। যেন আয়নায় মুখ দেখছেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বাড়ী ফিরে এলেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি পরলোক গমন করেন।

(সংগৃহীত)

Sunday 22 July 2018

কায়াহীনের কাহিনী।

স্বামীর কথা আজও মনে পড়ে সুমিতার। স্বামী অল্প বয়েসেই তাকে ছেড়ে চলে যায়, কারণ সেই দুরারোগ্য ব্যাধি, ক্যান্সার। স্বামী তাকে খুবই ভালবাসত, অভাবের সংসার হলেও তাদের আনন্দের কোন অভাব ছিল না। হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত রাজীবের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ল। সুমিতার একমাত্র অপছন্দের কারণ ছিল রাজীবের চেন স্মোকিং আর সেটাই কাল হল। মাত্র ৩১ বছর বয়েসেই এই পৃথিবী ছেড়ে তাকে চলে যেতে হল। সুমিতা একা হয়ে গেল। এক ঝটকায় তার সুন্দর জীবনে অন্ধকার নেমে এল। সে কোনরকমে একটা চাকরি জোগাড় করল কিন্তু মনে আর শান্তি রইল না।

স্বামী মারা যাবার পর বেশ কয়েকমাস হয়ে গেছে। সে অফিসে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পাচ্ছিল না। বসের বকাবকি খেয়ে মনমেজাজ বেশ খারাপ। সোমবার অফিসে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তার টেবিলের ওপরেই ফাইলটা পড়ে রয়েছে। আশেপাশের সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করল কেউ নিজে থেকে ফাইলটা খুঁজে পেয়ে দিয়ে গেছে কিনা। কেউই কিছু বলতে পারল না। সুমিতা এর কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না। যাই হোক, এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি সে আর মাথা ঘামাল না। হয়ত কোন উপকারী বন্ধু, যে নিজের পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক।

কয়েকদিন পরের কথা। সুমিতা নিজের ঘরে বসে রয়েছে। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামতে যায়। হঠাৎ মনে হল যেন পাশের ঘর থেকে কেউ খুব আস্তে বেহালা বাজাচ্ছে। গাটা যেন ছমছম করে উঠল তার। রাজীবও বেহালা বাজাতে খুব ভালবাসত। কিন্তু এ কি করে সম্ভব? পাশের ঘরে একবার গিয়ে দেখবে নাকি? সাহস করে একবার দরজাটা ঠেলে দেখল আবছা অন্ধকারের মধ্যে যে দোলান চেয়ারে বসে রাজীব মাঝে মধ্যে বেহালা বাজাত, সেই চেয়ারটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে দুলছে। সারা শরীরে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল সুমিতার। তবে কি রাজীবের অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারেনি? তার আশেপাশেই ঘুরছে? তাকে ভুলতে পারছে না? এটা কি শুভ না অশুভ ইঙ্গিত? সুমিতা আর ভাবতে পারছে না।

আরেকদিনের কথা। সুমিতা বাজার করে সকালবেলা ফিরছিল। বাজারের আগে রাস্তাটা পার করতে গিয়ে মনে হয় একটু অন্যমনস্কই হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই সামনে চলে এল যমদূতের মত এক প্রকাণ্ড লরি। সুমিতার মনে হল বোধহয় এই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। আর তার বাঁচা হল না। হঠাৎই লরির ড্রাইভার যেন কি দেখে ভয়ে প্রাণপণ চিৎকার করে সশব্দে ব্রেক কষল। সুমিতা চোখ বন্ধ করেই ফেলেছিল। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে যে সে বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং লরিটা ঠিক তার দুহাত সামনে থেমে রয়েছে। সম্পূর্ণ অলৌকিক ব্যাপার। আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সুমিতা বাড়ি ফিরে এল। ড্রাইভারটা তখনও “ভুত ভুত” বলে বিড়বিড় করছে।   

আরও কয়েকদিন পরের কথা। দুপুরের রান্না চাপিয়ে চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল সুমিতা। কখন যে চোখের পাতাদুটো ভারি হয়ে এসেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ রান্না পোড়া যাওয়ার গন্ধে তার চটকা ভাঙল। একি? রান্নাঘরে তো পুরো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে! গ্যাস সিলিন্ডারটা লিক করেছে নির্ঘাত। এইবার তার আর পরিত্রাণ নেই। চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করল। হঠাৎ করে কে যেন এক বালতি জল রান্নাঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। তাজ্জব ব্যাপার। সুমিতা দেখল জাদুমন্ত্রের মত আগুনটা নিভে গেল। এইভাবে সে আরেকবার ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেল। মনে মনে সে সেই অশরীরী অথচ উপকারী বন্ধুকে ধন্যবাদ জানাল। 

আরেকদিনের ঘটনা। অফিস থেকে বেরোতে বেশ দেরিই হয়ে গেছিল সুমিতার। তার বাড়ির আগে একটা পার্ক পড়ে যেখানে রাত্রিবেলা কিছু সমাজবিরোধী আস্তানা গাড়ে। পার্কটার কাছে পৌঁছে লক্ষ্য করল তিন চারজন লোক তার পিছু নিয়েছে। সে ভয় পেয়ে পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু লোকগুলোও চলার গতি বাড়াল। খারাপ মতলবই মনে হচ্ছে। মনে মনে সুমিতা ইষ্টনাম জপ করতে লাগল। হঠাৎই দুটো লোক লাফ দিয়ে পড়ে সামনে রাস্তা আটকাল। মুখে একটা অশ্লীল মন্তব্য করে তার দিকে এগিয়ে এল। আজকাল মেয়েরা আত্মরক্ষার জন্য লঙ্কার স্প্রে, ছোট ছুরি এবং আরও অন্যান্য জিনিস সঙ্গে রাখে। দুর্ভাগ্যবশত আজ ও রকম কিছুই তার সঙ্গে নেই। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এল। নাহ, আজ নিজের সম্মানটুকু রক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না। হঠাৎই জাদুমন্ত্রের মত একটা ব্যাপার ঘটে গেল। একদম সামনের লোকটাকে অদৃশ্য কেউ যেন এক ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দিল। পাশের জনকে কেউ যেন জামার কলার ধরে মাটি থেকে হাতখানেক উপরে তুলে দিয়েছে। ভয়ে হাত পা ছুঁড়ছে লোকটা। ব্যাপার স্যাপার দেখে অন্য দুটো লোক বেশ ঘাবড়ে গেল। পিছু ফিরে দে দৌড়। এরকম কাণ্ড কারখানা জীবনে তারা দেখেছে বলে মনে হয় না। সুমিতার সামনের দুটো লোকও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাল। সুমিতা কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে পায়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিল। আজও সে এক ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেল। রাজীব যেন অন্য জগতে গিয়েও তাকে ভুলতে পারেনি। কায়াহীন অস্তিত্ব নিয়েও তাকে সবসময় অনুসরণ করে চলেছে এবং সব রকম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে। সুমিতা মনে মনে ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল এই ভেবে যে এই অলৌকিক ঘটনা খুব কম লোকের জীবনেই ঘটে আর সে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। এক অপূর্ব প্রশান্তিতে তার মন ভরে উঠল।

Saturday 23 June 2018

বৈশিষ্ট্য।

সুদেষ্ণার খুবই অদ্ভুত লেগেছিল যখন এত খেলনা থাকতে মেয়ে রিমি ওই পুতুলটা কিনে দেবার জন্যই বারবার করে বায়না করছিল। মেয়ে খুবই জেদি আর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মার কাছেই তার সব চাহিদা। এমনিতে হট হুইলস বা জি আই জো বেশি পছন্দ করে, বারবি ডলও অপছন্দ নয়, কিন্তু আজকে নিউ মার্কেটের এই খেলনার দোকানে এসে সে যেন কিছুতেই ওই অদ্ভুত পুতুলটার থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। পুতুলটা একটা মেয়ে পুতুল কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি একদমই আর পাঁচটা সাধারণ পুতুলের মত নয়। কেমন যেন ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রয়েছে, চোখগুলোও যেন বিস্ফারিত। হঠাৎ দেখলেই যেন গাটা কেমন শিউরে ওঠে। যাই হোক, মেয়ের বায়না সামলাতে না পেরে তিনশ টাকা দিয়ে কিনেই দিল পুতুলটা। কিন্তু মনটা যেন কেমন খচখচ করতে লাগল।

অনেকক্ষণ পুতুলটা নিয়ে খেলার পর রাত্রিবেলা পুতুলটা মাথার কাছেই নিয়ে শুয়ে পড়ল রিমি। সে আজকে খুবই খুশি মা তার বায়না মেনেছে বলে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল তার। করিডোরের আলোটা যেন কে জ্বালিয়ে দিয়েছে আর কেউ যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার কাছে। ভালো করে দেখার আগেই যেন মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর লাইটটাও কেউ নিবিয়ে দিল। বাড়িতে তো সে আর মা ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু মা তার সাথে এরকম করবে কেন? হঠাৎই তার পুতুলটার ব্যাপারে খেয়াল হল। ওটাকে সে শুইয়ে রেখেছিল, কিভাবে যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে। পুতুলটাকে ঠিকঠাক শুইয়ে সে নিজেও শুয়ে পড়ল। আবার কিছুক্ষণ আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থা। হঠাৎ মনে হল ঘরের ঠিক মাঝখানে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেডল্যাম্পটা জ্বালিয়ে তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল রিমি। কিন্তু কেউ নেই। একবার ভাবল মাকে ডাকবে। আবার একটু দ্বিধাবোধ করল। কি দরকার, বকাবকি করবে, সারাদিন অফিসে অজস্র কাজ করতে হয়। তারই মনের ভুল হবে। আবার সাহস করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল, তার একদম ঘাড়ের কাছে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। পাশ ফিরেই দেখল পুতুলটা একদম বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তিনফুটের পুতুল যেন ছফুট লম্বা হয়ে গেছে আর তার মুখের অভিব্যক্তি যেন আরও হিংস্র হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে সে রিমির দিকে এগিয়ে আসছে। গলায় যেন ফাঁসের মত কী একটা চেপে বসল। অন্ধকারের মধ্যে যেন আরও ঘন অন্ধকার নেমে আসছে। রিমির নিথর শরীরটা বিছানার ওপর এলিয়ে পড়ল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সুদেষ্ণার কেমন যেন একটা খটকা লাগল। রিমির স্কুলের দিনে কোনদিন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয় না, কিন্তু আজকে তো তার কোন সাড়াশব্দ নেই। রিমির ঘরের কাছে গিয়ে দেখল দরজাটা আলতো করে ভেজানো। একটু ঠেলা দিতেই পুরোপুরি খুলে গেল। রিমির নিষ্প্রাণ দেহটা এলিয়ে পড়ে রয়েছে বিছানায়। চোখগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে আর তার গলাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে পুতুলটা যেন একটা পৈশাচিক হাসি হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। একটা মর্মান্তিক আর্তনাদ করে সুদেষ্ণা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

Sunday 27 May 2018

অভিশপ্ত ইঁদারা।

মনোজদের বাড়িটা বেশ পুরানো। প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি বাড়িটার বয়েস। বাড়িটার পিছন দিকে একটা ইঁদারা বা বাঁধানো পাতকুয়া আছে। কিন্তু বহু বছর আর ওটা কেউ ব্যবহার করেনা। বাড়িটার কিছু ইতিহাসও আছে বটে। এই বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন তার স্ত্রী সাংসারিক কারণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক ওই ইঁদারায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর ওই বাড়ির মালিক মনোজের ঠাকুরদাকে বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে চলে যান। কোথায় যান, তা আর জানা যায়নি বা কেউ জানার চেষ্টাও করেনি। ইঁদারার আশেপাশে এখন ঝোপঝাড় গজিয়ে গেছে। ওই দিকটা সবাই এড়িয়েই চলে। ওটা নাকি অশুভ। বহু বছর আগে মনোজের ঠাকুমা একবার জল তুলতে গিয়ে ভয়ংকর কিছু দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। তার পর থেকে যে ক বছর বেঁচে ছিলেন, সে সময় তার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা গেছিল। সব সময় বিড়বিড় করে কি বলতে থাকতেন, বোঝাই যেত না। 

মনোজ ছোটবেলা থেকেই বেশ সাহসী এবং যেকোনো অজানা ব্যাপারই তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। এখন সে কলেজে পড়ে। মাকে একদিন খেতে বসে ইঁদারাটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাও করেছিল কিন্তু মা তার দিকে এমনভাবে তাকাল যে সে আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ইঁদারাটার ব্যাপারে জানার কৌতূহল তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। একদিন সে এই ইঁদারার ব্যাপারটা ঠিক জানবে মনে মনে স্থির করল।


মনোজ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কবে বাড়িটা একটু ফাঁকা হবে। কিন্তু কিছুতেই সেই সুযোগ সে পাচ্ছিল না। বাড়িতে সব সময় লোক রয়েছে। অবশেষে সেই সুযোগ সে পেল। তাদের এক দুরসম্পর্কের আত্মীয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বাড়ির সব লোকই নিমন্ত্রিত। সে না যাবার একটা ছুতো খুঁজছিল। হঠাৎই মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে মাকে বলল পেটটা বড় ব্যথা করছে, অতএব সে যেতে চায় না। তাছাড়া সামনে পরীক্ষাও আছে, তার জন্য কিছু পড়ার কাজ বাকি আছে। মা অনুমতি দিল বাড়িতে থাকার। ব্যাস, আর কি চাই? কিন্তু বাড়ির লোকেরা রওনা দিতে দিতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে যাবে। সুতরাং সন্ধ্যের আগে কিছু করা যাবে না। বাড়ির লোকেরা সব বেরিয়ে যেতেই সদর দরজায় তালা দিয়ে সে হাতে একটা টর্চ আর লাঠি নিয়ে ইঁদারাটার দিকে এগোল। লাঠি নেবার কারণ সাপখোপ থাকতে পারে, যা ঝোপঝাড়! ইঁদারার কাছে এসে তার মনে হল মৃদু গলায় তাকে কেউ যেন ডাকল। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কেউ তো এসময় থাকার কথাও নয়। অগত্যা সে ইঁদারার দিকে মনোনিবেশ করল। নিচে জল আছে, কিন্তু ভিতরে বাইরে সব জায়গায় শ্যাওলা পড়ে গেছে। আকাশে হালকা চাঁদের আলো রয়েছে, তাও সে টর্চটা জ্বালল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এই কদিন আগেই টর্চে ব্যাটারি ভরা হয়েছে, বার কয়েক টিমটিম করে জ্বলেই নিভে গেল। মনোজের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। সে তবুও সাহস সঞ্চয় করল এবং ইঁদারার নিচের দিকে তাকাল। আবছা আলোয় মনে হল তার নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। কিন্তু প্রতিবিম্বটা যেন ক্রমশ বড় হচ্ছে আর উপর দিকেই উঠে আসছে। না, তার তো মাথায় এত বড় বড় চুল নেই আর মুখটাও এত ফ্যাকাসে নয়। এতো যেন কোন বয়স্ক মহিলার মুখ। অপলক দৃষ্টিতে মনোজের মুখের দিকে মুখটা তাকিয়ে রয়েছে। মুখের অভিব্যক্তি বর্ণনার বাইরে। মনোজের শরীরটা যেন শক্ত কাঠের মত হয়ে গেল, নড়াচড়া করার আর শক্তি নেই। হাত থেকে লাঠি আর টর্চ মাটিতে পড়ে গেল। হঠাৎ মহিলাটি তার দিকে হাত্টা বাড়াল। মনোজও মন্ত্রমুগ্ধের মত তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। কি হিমশীতল সেই স্পর্শ! তার দেহটাকে কেউ যেন পালকের মত তুলে নিয়েছে এবং ইঁদারার ভিতরে টেনে নিচ্ছে। তার মাথাটা নিচে আর পাগুলো ওপরে। ঠাণ্ডা জল তার শরীরটাকে স্পর্শ করল। সে ডুবছে, ক্রমশ ডুবছে। গলায় যেন ফাঁসের মত কি চেপে বসছে। তার সব অনুভূতি যেন তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ জলের উপরিভাগে একটু আলোড়ন, তারপর কয়েকটা শুধু বুদবুদ ভেসে উঠল। চারিদিক নিস্তব্ধ এখন।

পরের দিন সকালে বাড়ির লোকেরা দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে মনোজকে খুঁজে না পেয়ে তটস্থ। অবশেষে ইঁদারার পাশে পড়ে থাকা লাঠি আর টর্চ দেখে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল। রীতিমত দড়ি বেঁধে লোক নামিয়ে তার নির্জীব দেহটা তুলে আনা হল। সারা শরীরে যেন একফোঁটা রক্ত নেই, চোখগুলো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এল। পরে মনোজের বাবার নির্দেশে ইঁদারার মুখটা বন্ধ করে দেওয়া হল যাতে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা আর না ঘটে।

Sunday 1 April 2018

বন্ধ দরজা।

পাখির ছবি তোলা রণবীরবাবুর অনেকদিনের শখ। যখনই সুযোগ পান বেরিয়ে পড়েন তার নিকন ডি ৭০০০ ক্যামেরাটা পিঠে ঝুলিয়ে। দুর্দান্ত এস এল আর ক্যামেরা, পাখির ছবি তোলার জন্য একেবারে আদর্শ। সঙ্গে ৮০-৪০০ লেন্সও রাখেন। তার তোলা ছবি বিভিন্ন নামকরা বন্যপ্রাণী বিষয়ক পত্রিকায় ছাপা ও প্রশংসিত হয়। এইবারে খবর পেলেন বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর চুপি চরে নানারকম বিদেশী পরিযায়ী পাখি আসে। অতএব পূর্বস্থলী যেতেই হচ্ছে। সকালবেলা বিধাননগর স্টেশন থেকে কাটোয়া লোকাল ধরলেন। পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়েই গেল। পৌঁছে স্টেশনের কাছেই একটা ছোটখাটো হোটেলে দুটো খেয়ে নিলেন। স্টেশন থেকে চুপি চর যাবার ভ্যান রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়, তারই একটা নিয়ে রওনা দিলেন। পথেই রিকশাওয়ালার মুখে জানতে পারলেন, পাখির ছবি তোলার একদম আদর্শ সময়ে (জানুয়ারি মাস) এসেছেন। চুপি চরে পৌঁছে দেখলেন পাখির ছবি তোলার উৎসাহী লোকজনের অভাব নেই। নৌকায় উঠে তিনিও ফটো তুলতে মগ্ন হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন ধরনের পাখি, তাদের বিভিন্ন রকমের আচার আচরণ, খুবই মনমুগ্ধকর। ফটো তুলতে তুলতে সময় যে কি ভাবে কেটে গেল, টেরই পেলেন না। হঠাৎই খেয়াল হল যে বিকেল হয়ে এসেছে, বাড়ি ফিরতে হবে। তড়িঘড়ি মাঝিকে বলে নৌকা পারে লাগিয়ে নেমে পড়লেন। শিয়ালদা কাটোয়া লোকাল অনেকক্ষণ বাদে বাদে ট্রেন, মিস করলে আজকে আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না। একটা ভ্যান রিকশা ভাড়া পেয়ে গেলেন, উঠেই বললেন, “স্টেশন, একটু তাড়াতাড়ি চলো ভাই।“ উত্তরে রিকশাওয়ালা বিড়বিড় করে কি বলল, বোঝা গেল না। মুখটা যেন একটু বেশি রকমই কাপড় দিয়ে ঢাকা।

রিকশা চলছে তো চলছেই, পথ যেন আর ফুরায় না। রণবীরবাবুর অবাক লাগল। চুপি চর থেকে পূর্বস্থলী স্টেশন অল্প কিছুক্ষণের পথ, এতো সময় কেন লাগবে? কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করলেন, “ও ভাই, স্টেশন এত সময় লাগছে কেন? রাস্তা ভুল করলে নাকি?” কোন উত্তর নেই। একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন, কিছুক্ষণ আগে ডানদিকে একটা মন্দির ছেড়ে এসেছিলেন, আবার সেই মন্দিরটা সামনে দেখা যাচ্ছে। একই রাস্তায় বারবার করে ঘুরছেন নাকি? ভয়ে শিউড়ে উঠলেন। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “ও ভাই, কি হল, রাস্তা ভুল করলে নাকি?” রিকশাওয়ালা নির্বাক। হঠাৎই একটা ঝটকা দিয়ে রিকশাটা দাঁড়িয়ে পড়ল। রণবীরবাবু বলে উঠলেন, “কি হল? হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে যে?” ভাঙা ভাঙা গলায় জবাব এল, “চেন পড়ে গেছে বাবু, রিকশা আর যাবে না।“ রণবীরবাবু দেখলেন মহা বিপদ। জিজ্ঞাসা করলেন, “এখান থেকে স্টেশন কিভাবে যাব?” রিকশাওয়ালা মুখে কিছু না বলে একটা মেঠো পথ দেখিয়ে দিল। অগত্যা কোন উপায় না দেখে সেই পথ ধরেই হাঁটতে শুরু করলেন। একটু গিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন রিকশাওয়ালা তাঁর রিকশা সমেত অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল তার। সামনে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অনেক দূরে দূরে একটা করে আলো, অল্প বাড়িঘর, কিন্তু বড্ড নির্জন। কিছুক্ষণ পরে একটা পোড়ো বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলেন। খুবই পুরনো বাড়ি, চারিদিকে কাঠের বেড়া দেওয়া। ঢুকেই আঁতকে উঠলেন। বাড়ির আশেপাশে বেশ কিছু মড়ার খুলি ও কাঠের পোড়া আসবাবপত্রের টুকরো ছড়ানো। তাড়াতাড়ি গেট খুলে বাইরে এসে আবার দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ গিয়ে আবার দেখলেন একটা পোড়ো বাড়ি। আরে, এই বাড়িটা তো আগের বাড়িটার মত হুবহু এক দেখতে। গেট খুলে সেই মড়ার খুলি ছড়ানো দেখে আবার দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসা, পথ চলতে থাকা। পরপর চার পাঁচবার রণবীরবাবুর একই অভিজ্ঞতা হল। সারা শরীর এই শীতকালে ঘামে ভিজে চপচপ করছে, পিঠে কামেরার ব্যাগটা মনে হচ্ছে যেন এক মণ ওজন। পাগুলো যেন অবশ হয়ে আসছে। আবার সেই পোড়ো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। বাড়িটা যেন তাকে চুম্বকের মত টানছে। মড়ার খুলিগুলো পেরিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটু ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। কিছুটা এগিয়ে আবার একটা দরজা। একটু ইতস্তত করলেন। মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, “খুলিস না, দরজাটা খুলিস না।“ দেখলেন দরজার তলা দিয়ে যেন পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তবুও দরজাটা খুলে ফেললেন। খুলে দেখলেন এক ভয়ংকর দৃশ্য। সারা ঘরে লেলিহান আগুনের শিখা এবং তার মধ্যে একটি যুবতী মেয়ে আগুন থেকে বাঁচবার জন্য আর্তনাদ করছে। কি মর্মান্তিক ও ভয়ংকর সে দৃশ্য! রণবীরবাবু যেন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লেন। আচমকা আগুনের শিখা রণবীরবাবুর দিকেও ধেয়ে এল। পালাতে গিয়েও পালাতে পারলেন না। যুবতী মেয়েটি যেন তাকে হাত ধরে টানতে লাগল। সারা শরীরে যেন উত্তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা লাগছে। আর্তস্বরে চিৎকারে ঘরটি যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। লেলিহান অগ্নিশিখা ক্রমশ দুজনকেই গ্রাস করল। মেঝে্তে পড়ে রইল শুধু একরাশ ছাই, দুটি মড়ার খুলি ও কিছু হাড়গোড়।
পুনশ্চঃ ওই বাড়িতে বহুবছর আগে আগুন লেগে বেশ কিছু লোকের প্রাণহানি হয়েছিল।

Saturday 17 March 2018

কাবেরী।

স্ত্রীর মৃতদেহটা আঁকড়েই বসে ছিল পরিমল। দীর্ঘ পাঁচ বছর ক্যানসারে ভোগার পরে আজই ছিল তার জীবনের শেষ দিন। ডাক্তাররা অবশ্য অনেকদিন আগেই জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। এই মারণরোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া খুবই কঠিন। তবুও আশা ছাড়েনি পরিমল। কিন্তু.........

বন্ধুরা এসে ডাকাডাকি করাতে হুঁশ হল তার। এই ভাবে তো বসে থাকলে চলবে না। শ্মশানে গিয়ে শেষকৃত্যের কাজ করতে হবে।

শ্মশানে চিতাতে যখন কাবেরীর দেহটা তিলে তিলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল পরিমল। মানুষের জীবন কত অনিশ্চিত, সেটাই হয়ত ভাবছিল। সে নিঃসন্তান, অতএব বাকি জীবনটা তাকে একাকিত্বের মধ্যেই কাটাতে হবে। পারবে কি সে?

বাড়িতে ফিরে এসে কিছুই ভালো লাগছিল না তার। চুপ করে ড্রয়িং রুমের সোফাটায় বসে ছিল। সাধারণত সে বেশি ধূমপান করে না, কিন্তু আজ পুরো দু প্যাকেট শেষ করে ফেলেছে। আজ খেতেও ইচ্ছা করছে না তার। আস্তে আস্তে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুম আসছে না......

কাবেরীর সঙ্গে তার আলাপ কলেজ জীবন থেকে। বহুদিনের সম্পর্ক তাঁদের এবং আগাগোড়াই বড় মধুর। তাদের জীবনে হয়ত স্বচ্ছলতার অভাব কখনো সখন অনুভূত হয়েছে, কিন্তু আনন্দের কোন অভাব ছিল না।     

আস্তে আস্তে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল পরিমলের। সারাদিনের শ্রান্তির ফলেই হয়ত। হঠাৎ যেন মনে হল তাকে কেউ ডাকল। স্ত্রীলোকের গলার আওয়াজই মনে হল তার। ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারল না সে। এতো রাতে তাকে কে ডাকবে? ওই আবার! "পরিমল, পরিমল......।" ঘাড় ঘুরিয়ে বারান্দার দরজাটার দিকে তাকাল সে। একি দেখছে সে? সাদা কাপড় পরা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। এতো কাবেরী দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তাও কি করে সম্ভব? সে তো আজকে নিজে তাকে দাহ করে ফিরেছে। এ কীরকম তার রূপ? মুখের কাছটা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু শরীরের বাকি অংশটার মধ্যে দিয়ে বারান্দার রেলিংগুলো দেখা যাচ্ছে। ছায়ামূর্তি বলে উঠল, "আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না পরিমল। তাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। কিন্তু আমার উপায়ও নেই। আমাকে যেতে হবে। তবুও আমি আসব, মাঝে মধ্যে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব।" পরিমল বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। হঠাৎই তার খেয়াল হল, কাবেরীর অশরীরী ছায়ামূর্তিটা যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে ডেকে উঠল, "কাবেরী, কাবেরী, যেও না, দাঁড়াও।" উত্তর ভেসে এল, "আমি আবার আসব, তুমি যতদিন না নিজে থেকে আমার কাছে আসছ।" কাবেরীর অশরীরী ছায়ামূর্তিটা বাতাসে মিলিয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বিছানায় বসে থাকার পর পরিমলের খেয়াল হল, ভোর হয়ে এসেছে।

Saturday 10 March 2018

খারিজ।

মনটা বড়ই বিষণ্ণ হয়ে পড়ল প্রসেনজিতের। ঢাকুরিয়া লেকের একটা বেঞ্চিতে বসে রয়েছে সে। চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঝিলের ফুরফুরে হাওয়া, কিছুই তাকে আর আকর্ষণ করছে না। কিছুদিন আগেও সে প্রমিতার সঙ্গে এই বেঞ্চিতেই পাশাপাশি বসেছিল। তখন পরিস্থিতি ছিল একরকম। এখন...... পুরোপুরিই অন্যরকম। এতো বছরের প্রেম আর ভালবাসার এই প্রতিদান? পারল কি করে প্রমিতা, যাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি মনে করে এসেছে?
কাল রাত্রেই ফোনটা এসেছিল। “সরি প্রসেনজিৎ, এতোদিন আমাদের মধ্যে যা হয়ে এসেছে, সেটা প্লিজ ভুলে যাও। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর আমি বাবার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারব না।“ কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। রিং ব্যাক করা সত্ত্বেও আর রিসিভ করেনি।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। আস্তে আস্তে ঢাকুরিয়া লেক ফাঁকা হয়ে আসছে। তবুও বসে রইল সে। মনের ভিতরে যে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে, সেটা কিছুটা প্রশমন করতেই বোধহয়। কিন্তু সময় যতই কাটছে, আগুন নেভা তো দুরের কথা, আস্তে আস্তে সেটা যেন একটা দাবানলের রুপ নিচ্ছে। না, এতদিন সে যাকে এতো ভালবেসে এসেছে, তাকে অন্য কেউ পাবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। দরকার হলে সেই অন্য পুরুষকে সে এই দুনিয়া থেকে......
প্রায় সাতটা বাজতে চলল। ঝোলাব্যাগটা আলগোছে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে প্রসেনজিৎ ঢিমেতালে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। হঠাৎ সে এতোটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়েছে, সে যেন এটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ভালবাসায় আঘাত হয়ত তাকে নৃশংস করে তুলছে, তার ভিতরের আদিম রিপুটাকে জাগিয়ে তুলছে।

দুএকদিনের মধ্যেই প্রমিতার হবু বরের ব্যাপারে সবই জানতে পারল প্রসেনজিৎ। প্রমিতাদের হাউসিং কমপ্লেক্সেই সে থাকে এবং তার বাবা ও প্রমিতার বাবা বাল্যবন্ধু। বিদেশ থেকে ম্যানেজমেন্ট পাশ করে আসা ছেলে, এখানেই কোন একটি নামকরা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে উচ্চপদস্থ র‍্যাঙ্কে চাকরি করে। এই জন্যেই কি প্রমিতা তার সঙ্গে এইরকম করল? সে একটা বেসরকারি স্কুলে পার্ট-টাইম টিচার বলেই কি তার সঙ্গে এই রকম হল? তাহলে কি পুরো ব্যাপারটাই প্রেমের নাটক?
সে ঠিক করেই ফেলেছে কি করবে। আর দুয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে, আর প্রমিতা তার হবু স্বামীর সঙ্গে নাকি প্রায়ই শপিঙে বেরোচ্ছে। শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষা। পাড়ার এক কুখ্যাত গুণ্ডার থেকে অ্যাসিড বাল্বটা সে জোগাড় করে ফেলেছে। তবে জায়গাটা একটু নির্জন না হলে হবে না। ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে।     
সুযোগটা একদিন হাতে নাতেই পেয়ে গেল প্রসেনজিৎ। রাসবিহারী থেকেই দুজনকে অনুসরণ করছিল সে। বিবেকানন্দ পার্কের কাছটা সন্ধ্যের পর অনেকটাই নির্জন হয়ে যায়। ভাড়া করা বাইকটা কাজ হাসিল হওয়ার পর পালিয়ে যেতে কাজ দেবে। হেলমেট পরে রয়েছে, সুতরাং তাকে কেউ চিনতে পারবে না। আরেকটু, আরেকটু কাছে আসুক দুজনে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে পুরো উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। ব্যাস, দুজনেই একদম সামনে এসে পড়েছে। আর দেরি নয়। অ্যাসিড বাল্বটা সাইডব্যাগ থেকে বার করে বিদ্যুৎবেগে সে প্রমিতার হবু স্বামীর মুখে ছুঁড়ে মেরেই আর দাঁড়াল না। নারী পুরুষের সম্মিলিত চিৎকারে চারিদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠল। কিন্তু সে কর্ণপাত না করে ঝড়ের বেগে বাইক চালিয়ে অকুস্থল থেকে বেরিয়ে গেল।               
সপ্তাহ দুই পরের কথা। কাগজের এক কোণায় প্রমিতার হবু স্বামীর মৃত্যুসংবাদটা বেরিয়েছে। বহু চেষ্টা করেও ডাক্তাররা তাকে বাঁচাতে সক্ষম হননি। পুলিস হন্যে হয়ে খুনিকে খুঁজছে কিন্তু এখনো সফল হয়নি। মনে একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি অনুভব করল প্রসেনজিৎ। এই আনন্দে সে আজ প্রচুর পান করবে। শহরের এক নামকরা পানশালাতে ঢুকে নিজের পছন্দমত ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিল সে। মনের আনন্দে পান করে চলল। পান করতে করতে ঘড়ির কাঁটার দিকে খেয়ালই নেই। পানশালার মালিক দুএকবার তাড়া লাগিয়ে যখন বলল যে বন্ধ করার টাইম হয়ে গেছে তখন তার খেয়াল হল। টলতে টলতে সে বাড়ির পথে রওনা হল। আস্তে আস্তে সে সেই জায়গাটায় পৌঁছল যেখানে সে অ্যাসিড বাল্বের হামলা করেছিল। পার্কের রেলিঙের ওপর ভর দিয়ে একটু দাঁড়াল সে। একটু দম নিল। দূরে কে যেন একটা আসছে। পাত্তা দিল না সে। কিন্তু লোকটা যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাঁধে একটা সাইডব্যাগও মনে হচ্ছে আছে। নেশার্ত চোখে সে মুখটা বোঝার চেষ্টা করল। একি? এতো প্রমিতার হবু স্বামীর মুখ, একেবারে অবিকল। কি করে হয়? সে তো মারা গেছে, আজকের কাগজ তো তাই বলছে। কিছু বোঝার আগেই তরল আগুনের মত কিছু যেন তার মুখে কেউ ছুঁড়ে মারল।  উফফ, অসহ্য, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। চারিদিক আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে গেল প্রসেনজিতের কাছে।               
দুই সপ্তাহ পরের কথা। কাগজের এক কোণায় প্রসেনজিতের মৃত্যুসংবাদটা বেরিয়েছে। যমে মানুষে লড়াই করেও ডাক্তাররা তাকে বাঁচাতে সক্ষম হননি। পুলিস হন্যে হয়ে খুনিকে খুঁজছে কিন্তু এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

Monday 5 March 2018

অভিশপ্ত বাংলো।

বাংলোবাড়িটায় ওরা নতুনই এসেছে। ওরা বলতে জয়িতা, তার বাবা মা, ছোট ভাই শুভাশিস এবং পোষা আলসেশিয়ান টমি। জয়িতার বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বদলির চাকরি, তাই বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। জয়িতা ও তার ভাই দুজনেই স্কুলে পড়ে, চার বছরের ছোট বড়। কিন্তু যবে থেকে তারা এখানে এসেছে, কিছু একটা অশুভ ছায়া যেন তাদের তাড়া করে ফিরছে। তারা যখন গাড়ি থেকে নেমে বাংলোতে ঢুকছিল, একটা আধপাগলা লোক পাশ দিয়ে বলতে বলতে বেরিয়ে গেল, “এ বাড়িতে এসেছ তোমরা? চলে যাও, এখুনি চলে যাও, মরবে, এ বাড়িতে থাকলেই সব মরবে!” সবার মনে যেন একটা অশুভ ইঙ্গিত খেলে গেল।
একদিন শুভাশিস দিদিকে বলল, "দিদি, তুই এখানে রাত্রিবেলা কোন আওয়াজ শুনতে পেয়েছিস?" জয়িতা বলল, "কই নাতো?" শুভাশিস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “আমি যেন রাত্রিবেলা কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কাঁদছে।“ জয়িতা বলল, “দুর বোকা, ও তোর মনের ভুল।“ ব্যাপারটা আর বেশিদুর গড়াল না।
একদিন বাজার করতে গিয়ে জয়িতার বাবার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আলাপ হল। ওদের বাংলো ছাড়িয়ে গেলে একটা মাঠ পড়ে, তার পাশেই ওনার বাড়ি। কথায় কথায় বাংলোটার প্রসঙ্গ এসেই গেল। ওরা ওই বাংলোতে উঠেছে শুনেই ভদ্রলোক যেন একটু থম মেরে গেলেন। জয়িতার বাবা কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন, “ওই বাড়িতে বহু বছর আগে একটা খুন হয়। স্ত্রীর সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্ক আছে সন্দেহে স্বামী স্ত্রীকে খুন করে। এর কিছুদিন পরে স্বামীরও অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়। এর পর যারা যারাই ওখানে থেকেছে, তাদেরই কোন না কোনভাবে অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। ও বাড়ি ভাল নয় মশাই, অভিশপ্ত।“ বলেই ভদ্রলোক জোর পায়ে হাঁটা দিলেন। জয়িতার বাবা চিন্তাচ্ছন্ন মনে বাড়ি ফিরে এলেন। তবে কাউকে কিছু বললেন না।     

আরেকদিনের কথা। পরের দিন কেমিস্ট্রি পরীক্ষা, একটু বেশি রাত জেগেই পড়ছে জয়িতা। পড়ার ঘরের পাশে একটা বারান্দা, লাগোয়া একটা জানলাও আছে। হঠাৎই মনে হল, বারান্দা দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি চলে গেল। এতো রাতে বাড়ির আর তো কেউ জেগে থাকার কথা নয়। চট করে বারান্দায় গিয়ে দেখল কেউ নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার যেন একটা আওয়াজ আসছে। গায়ে কাঁটা দিল জয়িতার। তাড়াতাড়ি সে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
পরের দিন সকালে প্রাতরাশ করতে করতে সকলের খেয়াল হল, টমি তো নেই। খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে বাগানের এককোণে ঝোপের নিচে টমির মৃতদেহটা পাওয়া গেল। অতবড় কুকুরটার কে যেন ঘাড়টা মটকে দিয়েছে। অশুভ একটা ইঙ্গিতে সবার যেন গা ছমছম করে উঠল। শুভাশিসের খুবই প্রিয় ছিল টমি, স্কুল থেকে এসেই তার সঙ্গে খেলা তার চাইই চাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “টমির এই অবস্থা কে করল? ও কার কি ক্ষতি করেছিল?” কারো কাছেই কোন সদুত্তর নেই।
পরের দিন জয়িতার বাবা অনেক রাত অবদি জেগে কিছু অফিসের কাজ করছিলেন। তার স্টাডির লাগোয়া একটা বারান্দা আছে এবং ঘরটা তিনতলায়। হঠাৎ তার মনে হল বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় তো বাড়ির কেউ এখানে থাকার কথা নয়। ভয়ে তার গাটা ছমছম করে উঠল। একই সঙ্গে কৌতূহলও হল। তিনি কাজের ডেস্ক থেকে উঠে বারান্দায় গেলেন। কই, কেউ নেই তো? একটু এগিয়ে রেলিংএর কাছটায় গেলেন। হঠাৎ মনে হল পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। পিছু ফিরে দেখতে যাবেন, কে যেন তাকে একটা জোর ধাক্কা মারল। রেলিঙটা নিচু, তার শরীরটা একটা পাক খেয়ে শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে একটু নড়েচড়েই স্থির হয়ে গেল।
পরের দিন বাড়ির অবস্থাটা চিন্তা করাই যায়। সবাই শোকস্তব্ধ, শোকসন্তপ্ত। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে এটাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না। কোনরকমে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আপাতত নেওয়া হবে, বাকি পরে ব্যবস্থা করা যাবে। গাড়ি আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যেই হয়ে গেল। পুরোনো অ্যামবাসাডার গাড়ি, ধীরে ধীরে চলছে। ড্রাইভারের মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জয়িতা অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, “আপনি গাড়িটা প্লিজ জোরে চালান, আমাদের ট্রেন ধরতে হবে।“ ড্রাইভারের কোন ভাবান্তর নেই। হঠাৎই গাড়িটা একটা অজানা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চলার পরে একটা জঙ্গলের কাছে এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার তাদের দিকে মুখ ফেরাল। ওরকম বীভৎস মুখ তারা জীবনে দেখেনি। মুখটা যেন সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে, তাতে রক্তবর্ণ দুটো চোখ। ড্রাইভার বলল, “আপনারা পৌঁছে গেছেন।“ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যেন হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। হঠাৎই মনে হল গাড়িটাকে কেউ ঠেলছে। কিন্তু পিছন দিকে তাকিয়ে তারা কাউকে দেখতে পেল না। দরজা খোলার চেষ্টাও বৃথা হল। আচমকা গাড়িটা যেন কিছুটা নিচের দিকে গোঁত্তা খেয়ে নেমে গেল এবং জলে কিছু পড়লে ঝপাং করে যেমন আওয়াজ হয় তেমনই একটা আওয়াজ হল। তবে কি গাড়িটা একটা পুকুরে পড়ল? তারা তো কেউই সাতাঁর জানে না। আর সাতাঁর জেনেও বা লাভ কি, প্রাণপণ চেষ্টাতেও গাড়ির দরজা খোলা সম্ভব হচ্ছে না। আস্তে আস্তে জলের রেখা গাড়ির জানলা ছাড়িয়ে উঠতে শুরু করল, ডুবছে, গাড়ি ডুবছে, চারিদিকে যেন একটা হিমশীতল স্তব্ধতা, শেষ মুহূর্তে শুধু কয়েকটা মর্মান্তিক আর্তনাদ। কয়েকটা বুদবুদ ছড়িয়ে দিয়ে গাড়িটা পুরোপুরি পুকুরের জলে তলিয়ে গেল।

Wednesday 28 February 2018

একলব্যের গুরুদক্ষিণা।

সবাই  তো  জানেন  যে  মধ্যম  পাণ্ডব  অর্জুন  একজন  অসাধারণ  তীরন্দাজ  ছিলেন। কিন্তু  অর্জুনের  থেকেও  একজন  দক্ষ  তীরন্দাজের  উল্লেখ  আছে  মহাভারতে।  তার  নাম  একলব্য।  একলব্য  ছিলেন  নিষাদ বংশের  সন্তান  অর্থাৎ ব্যাধ।  একলব্যের মনে প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল দ্রোণাচার্যের  কাছে অস্ত্রশিক্ষা নেবেন। কিন্তু দ্রোণাচার্য তাকে আশ্রম থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত নয় বলে। এর ফলে তিনি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। যে মাটির ওপর দিয়ে দ্রোণাচার্য হেঁটে গেছিলেন সেই মাটি দিয়ে গুরু দ্রোণাচার্যের মূর্তি বানিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। সেই মূর্তিকেই গুরু মানলেন এবং তীর ধনুক চালানো অভ্যাস করতে লাগলেন। শৃঙ্খলা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্রমে তিনি অর্জুনের থেকেও দক্ষ তীরন্দাজ হয়ে উঠলেন। কোন প্রাণীকে না দেখে শুধুমাত্র তার আওয়াজ শুনেই তাকে তীরবিদ্ধ করতে পারতেন। একটি  কুকুর তাকে অস্ত্রসাধনার সময় ঘেউ ঘেউ করে ডেকে বিরক্ত করত। তিনি তীর দিয়ে তার মুখটাকে এমনভাবে শরবিদ্ধ করে দিলেন যে সে আর ডাকতে পারবে না কিন্তু মরবেও না।

একদা গুরু দ্রোণাচার্যের  সঙ্গে কৌরব ও পাণ্ডব রাজকুমারেরা বনের মধ্যে অস্ত্র শিক্ষা করছিলেন। যে যার নিজের নিজের অভ্যাসে মন দিয়েছেন সবাই। এমন সময় একটি কুকুরকে আসতে দেখে সবাই হতবাক হয়ে যান । কারণ সেই কুকুরের মুখ ছিল বেশ কয়েকটি শরবিদ্ধ! মুখে অতগুলো তীর গেঁথে থাকার পরেও কুকুরটি বেঁচে আছে কী করে, সেই ভাবনায় অস্থির হলেন সবাই এবং বুঝতে পারলেন, যেই ব্যাক্তি এমন কাজ করতে পারেন তিনি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর! এর পরেই সশিষ্য গুরু দ্রোণাচার্য বনের গভীরে প্রবেশ করলেন। পাণ্ডবেরা একলব্যকে খুঁজে বার করলেন এবং অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কার কাছে অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেছ?" উত্তরে একলব্য বললেন, "দ্রোণাচার্য।" রাগে কাঁপতে কাঁপতে অর্জুন ফিরে এলেন এবং দ্রোণাচার্যকে বললেন, "আপনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আপনার আমাকে বিশেষভাবে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তা না করে আপনি অন্য আরেকজনকে তীরন্দাজি শিখিয়েছেন এবং আমার থেকেও দক্ষ বানিয়েছেন।" দ্রোণ অবাক হয়ে গেলেন এবং বুঝতে পারলেন না অর্জুন কার কথা বলছেন। যাই হোক, তিনি অর্জুনকে সাথে নিয়ে একলব্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। একলব্য তাঁদের দুজনকেই স্বাগত জানালেন। সেই মূর্তির কাছে নিয়ে গেলেন যাকে গুরু মেনে দিনের পর দিন তিনি অভ্যাস করেছেন। তখন দ্রোণাচার্য বললেন, "আমি মনে করেছিলাম অর্জুন আমার শ্রেষ্ঠ শিষ্য। কিন্তু এখন দেখছি তুমিই আমার শ্রেষ্ঠ শিষ্য এবং অর্জুনের থেকে অনেক বেশী দক্ষ তীরন্দাজ।" তখন একলব্য শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, "গুরুদেব, আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?" তখন দ্রোণাচার্য উত্তর দিলেন, "আমাকে গুরু মেনে যখন তুমি এতটা দক্ষতা অর্জন করেছ, আমি গুরুদক্ষিণা হিসাবে তোমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি চাইছি।" একলব্য জানতেন যে তিনি যদি গুরুদক্ষিণা হিসাবে তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি দেন তাহলে তিনি আর তীর ধনুক চালাতে পারবেন না। তবুও নির্দ্বিধায় তিনি ছুরি বার করে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি কেটে দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দিলেন। অর্জুনও মনে মনে খুশি হলেন যে তার আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।

একলব্যকে শিষ্য হিসাবে প্রথমেই যদি দ্রোণাচার্য গ্রহণ করতেন তাহলে মহাভারতের কাহিনী হয়ত কিছুটা ভিন্ন হতো।

Sunday 25 February 2018

বর্ষার সেই রাত।

ছোটবেলা থেকেই অর্ণবের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। পড়াশোনায় সে খুব ভালো ছিল বলে সেই স্বপ্ন তার পূরণও হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে সে খুব ভালো নম্বর পেয়ে সে এমবিবিএস পাশ করেছে। কিন্তু এবার ইন্টার্নশিপের জন্য তাকে এক বছর কলকাতার বাইরে কোন হাসপাতালে গিয়ে কাজ করতে হবে। ক্যানিং এর বাসন্তী ব্লকে তার পোস্টিং পড়ল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে রওনা হল। নতুন হাসপাতালের দায়িত্ব তার ভালই লাগল। সিনিয়ররা এবং সহকর্মীরা বেশ ভালো। গ্রামের লোকজনেরও ডাক্তারবাবুদের ওপর অগাধ বিশ্বাস। অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল অর্ণব। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাঝে মধ্যেই তাকে বসতে হয় এবং তার কাছে জ্বরজারি বিবিধ সমস্যা নিয়ে লোকেরা আসে এবং সে সাধ্যমত তাদের রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করে। এইভাবে চলছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎই এমন একটা ঘটনা অর্ণবের জীবনে ঘটল যুক্তিতে যার কোন ব্যাখা মিলবেনা।

বর্ষাকাল চলছে। সারাদিন ধরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সন্ধেবেলা ডিউটি থেকে ফিরে অর্ণব একটু মুড়ি চানাচুর নিয়ে বসেছে, হঠাৎই সদর দরজাটা কে যেন সজোরে ধাক্কাতে আরম্ভ করল, "ডাক্তারবাবু, বাড়িতে আছেন? দয়া করে দরজাটা খুলুন।" অর্ণব খুব বিরক্ত বোধ করল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর একটু বিশ্রামের অবকাশ, তাও উপায় নেই। সে বলল, "আমি খুবই ক্লান্ত। তাছাড়া আমাদের হাসপাতালের বাইরে প্র্যাকটিস করা নিয়ম নেই, আপনি এখন যান।" কিন্তু নাছোড়বান্দা কণ্ঠস্বরটি বলল, "হুজুর, একবার চলুন, আমার বাবার ধুম জ্বর, কিছুতেই কমছে না। বাড়ি বেশি দূর না, আর কাউকে পেলাম না বলে আপনার কাছেই এলাম।" অর্ণব আরও দুএকবার আপত্তি করল, কিন্তু লোকটি কিছুতেই শুনল না। অগত্যা সে দরজাটা খুলল। দরজা খুলতে না খুলতেই কড়কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেটুকু দেখতে পেল তাতে মনে হল রোগাপাতলা চেহারার একটি মাঝবয়সী গ্রাম্য লোক, আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা, মুখটাও ভালো করে খেয়াল করা যাচ্ছে না। সে চট করে একটা ছাতা আর তার ডাক্তারি সরঞ্জামের ব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে লোকটির পিছন পিছন চলতে লাগল। একে তো অন্ধকার গ্রামের রাস্তা, তার ওপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, যেন সামনের লোকটি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। লোকটি এতো দ্রুতগতিতে হাঁটছে যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না, খালি পিছিয়ে পড়ছে। তখন একটু হাঁকডাক দিয়ে  নিশ্চিত হচ্ছে যে লোকটি সঙ্গে আছে। বেশ কিছুটা পথ চলার পরে দূরে যেন একটা চালাঘর দেখা গেল। পথপ্রদর্শক লোকটি বলল, "ডাক্তারবাবু, আমাদের বাড়ি এসে গেছে।" আবার একটা বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেটুকু দেখা গেল, লোকটি আর তার পাশে নেই। চমকে গিয়ে অর্ণব ডাকতে লাগল, "ও মশাই, কোথায় গেলেন, ও মশাই?" লোকটি যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। বাধ্য হয়েই সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে চালাঘরটির দিকেই এগোতে লাগল। চালাঘরটির কাছে পৌঁছে দেখল যেন বিছানায় কেউ শুয়ে রয়েছে এবং আশেপাশে আরও কয়েকটি ছায়ামূর্তি ঘোরাফেরা করছে। অন্ধকারে কারোরই মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। অর্ণবকে দেখে কে যেন বলে উঠল, "বড় দেরি করে ফেললেন ডাক্তারবাবু, আর বোধহয় বাঁচবে না।" মহিলার গলায় একটা বুকফাটা কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। অর্ণবের কাছে সবই যেন কেমন ধোঁয়াশার মত লাগছে, তবুও একজন ডাক্তারের কর্তব্য পালনার্থে সে রোগীর পাশে বসে তার নাড়িটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু একি? চাদরের তলা থেকে যে হাতটি সে তুলে ধরল, তার স্পর্শ এত ঠাণ্ডা কেন? এতো রক্তমাংসের হাত নয়। এতো কংকালের হাত! আর তার চারপাশে কারা ভিড় করে এগিয়ে আসছে? এরা কি মানুষ? মানুষ এমন হয়? মনে হচ্ছে গায়ে চাদর জড়ানো একদল কংকাল, শুধু খুলিগুলো দেখা যাচ্ছে। সেগুলো যেন বীভৎসভাবে হাসতে হাসতে অর্ণবের দিকে চেয়ে বলছে, "আর তোর রক্ষা নেই, আজ আর তুই বাঁচলি না।" ছায়ামূর্তিগুলোর অন্ধকার তাকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই অর্ণব জ্ঞান হারাল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন এখন আরও জোরে জোরে পড়ছে।

পরের দিন সকালে গ্রামবাসীরা অর্ণবের মৃতদেহটা উদ্ধার করল। সারা শরীরে যেন এক ফোঁটাও রক্ত অবশিষ্ট নেই, কেউ যেন শুষে নিয়েছে। চোখগুলো যেন মরার আগের মুহূর্তে ভয়ংকর কিছু দেখে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। বহু বছর আগে ওই একই দিনে ওই জায়গায় বেশ কিছু লোক মহামারীতে মারা গেছিল। তারপর থেকে নাকি জায়গাটা অভিশপ্ত।

Monday 19 February 2018

মানিক মাঝির গল্প।

গ্রামের নাম কুসুমপুর। রাত অনেক। কিন্তু মানিক মাঝির চোখে ঘুম নেই। এভাবে চলতে থাকলে ভিটেমাটি সবই যাবে। পথে বসতে হবে পরিবার নিয়ে। মাছের ব্যবসায় যে এত মন্দা হবে, কে ভেবেছিল। আশেপাশের গ্রাম থেকে দুএকটা আত্মহত্যার খবর যখন কানে আসে, শরীরটা শিউড়ে ওঠে। পাশে বউ ছন্দা আর ছেলে ভুতো ঘুমিয়ে। মানিক উঠে বসল। ভবিষ্যতে কি করবে ভাবতে থাকে। সংসার চালানো, ছেলের পড়াশোনা। একে তো পুকুরগুলোতে সেইভাবে মাছ উঠছে না, তার উপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত নরেন ব্যবসার অনেকগুলো টাকা মেরে তাকে আরও বসিয়ে দিয়ে গেছে। কি উপায়? শুনশান রাত। দূরে মনে হয় একটা শেয়াল ডাকছে। মানিক ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে চোখটা যেন লেগে আসে প্রায়। সারাদিনের ক্লান্তির জন্য হয়ত।
হঠাৎ একটা চিন্তা তার মাথায় আসে। কাজটায় বেশ ঝুঁকি আছে। কিন্তু এছাড়া তার হয়ত উপায়ও নেই। ডুমুরজলা বলে গ্রামের যে জলাটা আছে, সেখানে রাত্তির করে মাছ ধরলে কেমন হয়? এক সময় অনেক মাছ পাওয়া যেত, আর রাতের বেলা কোন লোক থাকবে না, যা পাওয়া যাবে সবই তার। কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা বলে জলাটায় নাকি অপদেবতা আছে। আগেও রাতে মাছ ধরতে যাবার কথা ওঠায় অনেকেই বারণ করেছে। 'তেনাদের' অনেকেই ভয় পায় বটে। কিন্তু মানিক এখন মরিয়া। অভাবের তাড়নার জন্যই হয়ত। চকিতে ছিপ, গামছা, আর মাছের থলেটা বগলদাবা করে বেরিয়েই পড়ে মানিক। ঘুমের ঘোরেই যেন একটু পাশ ফিরে শোয় ছন্দা। তার বেরিয়ে যাওয়াটা টের পায় না।

হনহন করে হাঁটতে থাকে মানিক। তার ঘর থেকে জলা নেহাত কম দূর নয়। ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না। জলায় পৌঁছে একটা গাছের তলায় বসে জলে ছিপ ফেলে। চারদিকে বেশ চাঁদের আলো আছে। নাহ, বুদ্ধিটা খারাপ নয়, রুই, পোনা, কই, এটা ওটা উঠতেই লাগল। মানিকের মনে আনন্দ আর ধরে না। অনেকদিন পর সে ছন্দা আর ভুতোর মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারবে। আর গোটাকয়েক হলেই হবে। উল্লসিত মনে মানিক ছিপ ফেলে। এবারে মনে হয় বড় মাছ। ওরেব্বাস, কি ভারি মাইরি! ছিপ বেঁকে যাচ্ছে। মানিকও ছাড়বে না, হার মানবার পাত্র নয়। ছিপ ধরে টানতে থাকে। মাছটা অসম্ভব ভারি। মাছই তো? না অন্য কিছু? সে সমস্ত শক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে টান মারে। কি একটা যেন ফুটবলের মত জিনিস জল থেকে ছিটকে উঠে আসে। মানিক টাল সামলাতে না পেরে আছাড় খেয়ে পড়ে। পড়বি তো পড় জিনিসটা তার মাথার পাশেই পড়ে। কি ওটা? একি দেখছে মানিক? এতো একটা কাটা মুণ্ডু! আর মূখটা অবিকল তারই মতো। তফাৎ শুধু এইটাই, মুণ্ডুটার আগুনে চোখগুলো বীভৎসভাবে বিস্ফারিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রয়েছে আর ঠোঁটের দুই কোণ দিয়ে দুটো ধারালো দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, যা বেয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। একটা রক্ত জল করা হাসির শব্দ শুনতে পেল মানিক। তার আর কিছু মনে নেই।
ভোরবেলা গাঁয়ের লোকেরা মানিকের মৃতদেহটা জলার ধার থেকে উদ্ধার করল। শরীর থেকে সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিয়েছে। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। রহিম খুড়ো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, "ছাওয়ালটারে অনেক বারণ করসিলাম, শুনল না।" ছন্দা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একটা বুকফাটা আর্তনাদ করে নিথর দেহটার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল।

Tuesday 13 February 2018

শেষ ট্রেনের যাত্রী।

অফিসের কাজ শেষ করতে করতে বেশ দেরিই হল সুমন্ত্রের। একেই উইকএণ্ড, তার ওপর কাজ জমিয়ে রাখা একদমই পছন্দ না তার। অতএব দেরি। তড়িঘড়ি স্টেশনের দিকে রওনা হল সে। লাস্ট ট্রেনটা মিস করলে রাতটা প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে কাটাতে হবে, যেটা মোটেও সুমন্ত্রের পছন্দ না। ভাগ্যক্রমে ট্রেনটা পেয়েই গেল সে। কামরাতে উঠেই জানলার ধারে একটা সিটে বসে পড়ল। স্টেশনের নাম ভুদেবপুর (কাল্পনিক), শিয়ালদহ থেকে পাক্কা দুঘণ্টার পথ। স্টেশন থেকে তার বাড়ি হেঁটে গেলে ১০-১২ মিনিটের রাস্তা, আর রিকশায় চাপলে ৪-৫ মিনিট। কিন্তু স্টেশনে নামতে না নামতেই ঝমঝম করে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। ভুল করে সকালে আকাশ পরিস্কার দেখে ছাতাটাও আনেনি সে। তাই তাকে ভিজতেই হল। রিকশার জন্য আর সে অপেক্ষা না করে হেঁটেই রওনা হল। বৃষ্টির জন্য স্টেশন চত্বর একদমই ফাঁকা। ডেলি পাসেঞ্জারি করে বলে প্রত্যেকদিনই কাউকে না কাউকে সহযাত্রী হিসেবে পেয়েই যায় সে। কারো কারো বাড়ি তার বাড়ির রাস্তার পথেই। কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা। সে একাই স্টেশনে নেমেছে। কোনরকমে রুমালটা দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

আজ মনে হয় অমাবস্যা, চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ চলার পর বৃষ্টিটা একটু ধরল। স্টেশন পেরিয়ে ডানদিকে একটা বিরাট মাঠ পড়ে, মাঠের লাগোয়া শ্মশানও আছে। রাতে ওই জায়গাটা সবাই এড়িয়েই চলে। অনেক রকম অদ্ভুত আওয়াজ নাকি শোনা যায়। তবে সুমন্ত্র সাহসী মানুষ, এসব খুব একটা পাত্তা দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে মাঠটা প্রায় অতিক্রম করে এসেছে, হঠাৎ মনে হল কেউ তার পিছন পিছন আসছে। পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল লম্বা মতন কে হেঁটে আসছে। হয়ত তাদের গ্রামেরই কেউ।হঠাৎই মনে পড়ল, ওদের পাড়ার ভবতোষদা বেশ লম্বা, সেই নয় তো? ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞাসা করল, "ভবতোষদা নাকি? এত রাতে? কোথা থেকে ফিরলেন?" কিন্তু কোন উত্তর নেই। আর লোকটা যেন চলার বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। এবার কিন্তু সুমন্ত্র একটু ভয় পেল। সেও চলার গতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ওকি! লোকটা যেন ক্রমশ আরও লম্বা হচ্ছে। আরও কাছে আসছে। সুমন্ত্রর গলা শুকিয়ে গেল। লোকটা যেন রণপা লাগিয়ে তাকে ধাওয়া করেছে। সুমন্ত্র উপায়ান্তর না দেখে দৌড়তে শুরু করল। লোকটাও পিছু ছাড়ছে না। অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে গেছে লোকটা। যেন দৈত্য। সুমন্ত্র জীবনে কোনদিন এত জোরে দৌড়েছে বলে মনে পড়ল না। তার বাড়ি আর বেশি দূর নয়। আরেকটু, আরেকটু...... হঠাৎই মনে পড়ল রাম নাম জপ করলে নাকি ভুত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাই করতে করতে কোনরকমে নিজের বাড়ির দরজায় আছড়ে পড়ল। পাগলের মত দরজা ধাক্কাতে লাগল, "নীলিমা, নীলিমা! দরজা খোলো।" নীলিমা, তার স্ত্রী, দরজাটা খোলামাত্রই সে ঘরে ঢুকে সজোরে দরজাটায় খিল লাগিয়ে হাঁপাতে লাগল। নীলিমা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, "কি হয়েছে? এত হাঁপাচ্ছ কেন?" সুমন্ত্র বলল, "আগে একগ্লাস জল।" বলে সোফায় এলিয়ে পড়ল। নীলিমা জল নিয়ে এলে জলটা খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করল ও সমস্ত ঘটনাটা বলল। নীলিমা সব শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, "তুমি লোকটাকে প্রথমে ভবতোষদা ভেবেছিলে?" সুমন্ত্র বলল, "হ্যাঁ, কেন?" নীলিমা কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পরে উত্তর দিল, "ভবতোষদা তো আজ সকালে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।" চমকে উঠল সুমন্ত্র। তবে কি ওটা তার প্রেতাত্মা ছিল?

Monday 5 February 2018

ভুতুড়ে বাস।

কলেজ ছুটি হবার পরে বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে গল্প করতে করতে অনন্যার সময়ের আর খেয়ালই ছিল না। হঠাৎই ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর পড়ায় চমকে উঠল সে। এইরে, আজকে নির্ঘাত মার কাছে ঝাড় খেতে হবে। ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে দুএকবার ফোনও এসে গেছে। যথারীতি সে বলেছে, "বন্ধুর বাড়িতে আছি, চলে আসব, চিন্তা কোরো না।" কিন্তু এবারে তার টনক নড়ল। আর দেরি করলে বাস পাবে না। তার বাড়ি ফেরার একটাই বাস, না পেলে দুতিনবার ট্রেন পালটানো। সে অনেক ঝক্কি। তাড়াতাড়ি বান্ধবীকে টাটা করে দিয়ে বাসের জন্য রওনা হল অনন্যা। বাসে উঠে মাকে কি জবাবদিহি করবে, সেটাই ভাবতে লাগল।
অভাবের সংসার। বাবা তার ছোট থাকতেই গত হয়েছেন। মাই তাকে কষ্ট করে মানুষ করেছে। মার বড়ই বাধ্য মেয়ে সে। কিন্তু আজকে সে বড় অন্যায় করে ফেলেছে। আর কোনদিনও করবে না। আসলে কলেজে আজ ক্লাস শেষ হয়ে লম্বা ছুটি পড়ে গেল। সেই আনন্দে গল্প করতে করতে খেয়ালই নেই।

বাসটা চলছে বেশ দ্রুতবেগে। কিন্তু অনন্যার কেমন যেন একটা খটকা লাগল। বাসের ভিতরে যেন একটা আলো আধারি তৈরি হয়েছে আর সহযাত্রীরা তার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে দেখছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। কিন্তু জোর করে মনে সাহস সঞ্চয় করল। টেনশনে মানুষের অনেক সময় এরকম অনুভূতি হয়। শীতকালের কুয়াশার জন্য হয়ত এই আলো আধারি ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে। সে খুব একটা পাত্তা দিল না।

হঠাৎই তার নজরে পড়ল বাসটা বেশ খালি হয়ে এসেছে। একে তো রাত অনেক, তার ওপরে বাস প্রায় লাস্ট স্টপেজের কাছাকাছি এসে গেছে। লাস্ট স্টপেজের আগের স্টপে সে ছাড়া সবাই নেমে গেল। এখন বাসে শুধু সে, ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর। আচমকা বাসের সবগুলো আলো নিবে গেল। ব্যাপারটা অনন্যার কেমন লাগল। সে কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞাসা করল, "কি হল? বাসের সব আলো নিবিয়ে দিলেন কেন?" কন্ডাক্টর এর কোন উত্তর নেই। এমনকি সে মুখ ফিরিয়ে রইল। শীতের রাত বলে এমনিই লোকটা মাথায় একটা মাফলার জড়িয়ে রেখেছে, আর ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে আরোই তার মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। দুএকবার গায়ে ধাক্কা দিতে সে তার মুখটা অনন্যার দিকে ফেরাল। বিলীয়মান রাস্তার আবছা আলোতে তার মনে হল যেন একটা অন্তহীন গহ্বরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনন্যার সারা শরীরে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল। সে ড্রাইভারের কেবিনের দিকে দৌড়ে গিয়ে আকুলভাবে চিৎকার করতে লাগল, "ও দাদা, গাড়ি থামান, ও দাদা!" ড্রাইভারের কোন বিকার নেই। বাসের থামারও কোন লক্ষণ নেই। বেশ কয়েকবার কাকুতিমিনতি করবার পর ড্রাইভারও তার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল। চোখদুটোর গহ্বর যেন দুটি অগ্নিপিণ্ড। কি ভয়ংকর পৈশাচিক সেই দৃষ্টি! ছিটকে সরে এল অনন্যা। তবে কি মৃত্যু আসন্ন? না, এভাবে সে মরতে রাজি নয়। সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে যে দরজায় কন্ডাক্টর দাঁড়িয়ে ছিল না, সেই দরজা থেকে চোখ বুজে মারল এক লাফ। উফ, শরীরটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল তার। পাশ দিয়ে ভুতুড়ে বাসটা ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল। কোন দিকে গেল, কে জানে?
সকালবেলা অনন্যাদের পাড়ার শ্যামলবাবু বাজার করতে বেরিয়ে তার অজ্ঞান ও আহত দেহটা প্রথম দেখতে পান। শিগগিরিই তার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই অনন্যার মার বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করা এবং থানায় মিসিং ডায়রি করা হয়ে গেছে। যাই হোক, কথায় কথায় জানা গেল বহু বছর আগে সেখানে ঠিক ওই দিনে একটা বাস দুর্ঘটনা হয়েছিল যাতে ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর দুজনেই মারা যায়। দুজনেই নাকি মদ্যপ অবস্থায় ছিল। বাসে দ্বিতীয় লোক আর কেউ ছিল না।

Tuesday 30 January 2018

আলেয়া।

বদলির চিঠিটা হাতে পেয়েই সাব পোস্টমাস্টার রতনবাবু রওনা হওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। এবার গন্তব্যস্থল মদনপুর, শিয়ালদহ রাণাঘাট লাইনে কল্যাণীর ঠিক পরের স্টেশন। স্টেশনে নেমে কাছেই একটা সাব পোস্টঅফিসে তার নতুন দায়িত্ব। কোয়ার্টারেই থাকাখাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা।
অকৃতদার মানুষ, তাই বদলির চাকরিতে তার খুব একটা আপত্তি নেই। বরং তার বেশ ভালই লাগে নতুন জায়গায় ঘুরতে এবং নতুন নতুন মানুষজনের সঙ্গে মিশতে। অতএব তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়েই পড়লেন। পরের দিন সকালেই দায়িত্ব সব বুঝে নিতে হবে। শিয়ালদহ থেকে রাত সাড়ে নটার রাণাঘাট লোকালটা ধরে নিলেন। মদনপুর পৌঁছাতে এক ঘণ্টার একটু হয়তো বেশীই লাগবে। ট্রেনে অফিস্ ফেরতা মানুষের প্রচুর ভিড়, তবে নৈহাটি ও কল্যাণীতে অনেকেই নেমে গেল। মদনপুর পৌঁছে কথাই ছিল, নতুন সাব পোস্টঅফিসের পিওন তাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দেবে। সে একটা সাইকেল নিয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌতূহলী রতনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি। সে বলল, "হুজুর, কাল রাত থেকে মায়ের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, কিছুতেই কমছে না। ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হবে, সেও অনেকটা রাস্তা। এদিকে আপনিও আসবেন বলে অপেক্ষা করে আছি। কি করব, বুঝতে পারছি না।" রতনবাবু তাকে অভয় দিয়ে বললেন, "চিন্তা নেই, তুমি রাস্তাটা আমাকে বলে দাও, আমি একাই যেতে পারব। তুমি বরং ডাক্তারবাবুকে নিয়ে মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। ওটা বেশি জরুরী।" পিওন তাও যেন একটু ইতস্তত করছিল, তাকে এক ধমক দিয়ে রওনা করে দিলেন। যাবার সময় পিওনটি তাকে সাইকেলটা দিয়ে বলল, "হুজুর, স্টেশন রোড ছাড়িয়ে একটু গেলে ধানক্ষেত, ওই ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে রাস্তা, সোজা চলে যাবেন। পথে ডানদিকে একটা জলা পড়বে। জায়গাটা ভাল না। লোকে বলে নাকি ডাইনী আছে। কয়েকটা খুনখারাপিও হয়েছে ওখানে। তবে যদি কিছু অদ্ভুত দেখেন, সাইকেল দাঁড় করাবেন না। জলা পেরিয়ে কাউকে একটু জিজ্ঞাসা করবেন, পোস্টঅফিসের কোয়ার্টার যে কেউ দেখিয়ে দেবে।" সেইমত রতনবাবু সাইকেলে উঠে পড়লেন। সঙ্গে শুধু একটা ব্যাগ, সেটা ক্যারিয়ারে বেঁধে নিলেন। সাইকেলে লাইট আছে দেখে খুশিই হলেন। গ্রামের রাস্তা, তেমন আলো নেই। তার সুবিধাই হবে।

আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে মৃদুমন্দ চালে সাইকেল চালিয়ে চলেছেন রতনবাবু। মনে বেশ ফুর্তি। তার হঠাৎ কলেজ্ জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। সাইকেল করে ঘুরে বেড়ানো তার প্রিয় শখগুলির অন্যতম আর এটা সেই কলেজজীবন থেকেই শুরু। কত নির্জন জায়গায় রাত বিরেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কখনো ভয় পাননি। আসলে ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব সাহসী ও অ্যাডভেনচারাস প্রকৃতির। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে শ্মশানেও রাত্রিবেলা অনেকবার গেছেন কিন্তু ভয় পাওয়ার মত কিছু অভিজ্ঞতা তার হয়নি। পথে এক আধজন কে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে বুঝতে পারলেন, ঠিক পথেই চলেছেন।
একটু দূরে জলে হালকা চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখে বুঝতে পারলেন, জলাটার কাছে প্রায় এসে পড়েছেন। জলাটা খুব বেশি বড় নয়, পেরিয়ে যেতে তার বেশি সময় লাগবে না। তবে আশপাশটা যেন একদম নির্জন। হঠাৎই দপ করে জলার মাঝখানে যেন একটা আলো জ্বলে উঠল। এত রাতে কে ওখানে আলো জ্বালাবে? কৌতূহল হওয়ায় রতনবাবু সাইকেল দাঁড় করালেন। আস্তে আস্তে জলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। কই, কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। ওই, আবার সেই আলো! এবার যেন আরেকটু কাছে। জলের একটু উপরে, জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছে। আলেয়া নয় তো? রতনবাবু পড়েছেন, জলাভুমিতে এরকম নাকি রাত্রিবেলা গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের উৎপত্তি হয়, তার থেকে আলেয়া দেখা যায়। সেই দেখে অনেকে ভুত ভেবে ভয়ও পায়। আবার, আবার সেই আলো। আলোটা যেন চুম্বকের মত তাকে টানছে। এগিয়ে আসছে আলোটা, রতনবাবুও যেন সম্মোহিতের মত কাদা পাঁক ঠেলে এগিয়ে চলেছেন। সাইকেলটা পড়ে থাকল। তার কোন হুঁশ নেই। কোমর অবদি ডুবে গেল তার। প্রায় জলার মাঝামাঝি চলে এসেছেন। তাকে কে যেন টানছে নিচ থেকে। এতো মানুষের হাতের স্পর্শ নয়। মানুষের হাত কি এত শীতল আর শক্ত হয়? গলা, নাক সবই
পাঁকে ডুবে গেল তার। আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। কোন প্রতিরোধও করছেন না। চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে। নিশ্বাস নেওয়া দুরুহ ব্যাপার হয়ে পড়ছে। চোখের ওপর যেন কেউ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে যেন গলায় একটা হিমশীতল কঙ্কালের হাতের স্পর্শ......বড়ই নিষ্ঠুর, বড়ই ভয়ংকর সে স্পর্শ।

পরের দিন সকালে রতনবাবুর নিথর দেহটা জলার মাঝখান থেকে উদ্ধার করা হল। যে পিওনটির তাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, সে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সাহেবকে বারণ করেছিলাম, যদি কিছু অদ্ভুত দেখেন, জলার কাছে দাঁড়াবেন না। নিশ্চয়ই উনি শোনেননি।“ আশেপাশের লোকজন কথাটা শুনে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে যেন একটা অশুভ ফিসফিসানি ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

Tuesday 16 January 2018

হানাবাড়ি।

অঞ্জনদের পাড়ায় একটা খুব পুরনো বাড়ি আছে। ওই বাড়ির লোকেরা নাকি এককালে খুব ধনী ছিল। এখন তাদের বংশধরেরা কেউই আর নেই। বাড়িটার দেখাশোনা করা বহুদিন ধরেই বন্ধ। বাড়িটার সম্পর্কে লোকজনের কৌতূহলের অন্ত নেই। কিন্তু বাড়িটা ভুতুড়ে বলে কেউ বাড়িটার ধারকাছ মাড়ায় না।
ছোটবেলা থেকেই অঞ্জনের খুব আগ্রহ বাড়িটার প্রতি। শুধু তার বাড়ির লোকেদের বারণের কারণেই সে বাড়িটায় কোনদিন ঢোকেনি। সেদিন তাড়াতাড়ি হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে গেল। সে আর তার প্রিয় বন্ধু প্রকাশ বাড়ি ফিরছিল। বাড়িটা তাদের স্কুল থেকে ফেরার পথেই পড়ে। হঠাৎই অঞ্জন প্রকাশকে জিজ্ঞাসা করল, "হ্যাঁরে, এই পোড়ো বাড়িটা সম্বন্ধে তুই কিছু জানিস?" প্রকাশ সন্দিগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, "তেমন কিছু না। তবে বাড়িটা অভিশপ্ত। ওই বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন, তিনি নাকি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছিলেন। গুলি চালিয়ে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলে নিজেও আত্মহত্যা করেন। কেন?" অঞ্জন বলল, "না, ভাবছি বাড়িটার ভিতরে একদিন ঢুকে দেখব কি আছে।" প্রকাশ ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, "না না, একদম না। ওই চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দে। ওটা ভুতুড়ে। চল বাড়ি যাই।" তার কথামত সঙ্গে কিছুটা গিয়ে অঞ্জন অনুভব করল বাড়িটা যেন তাকে তীব্রভাবে টানছে। ওই বাড়িটায় কিছু যেন একটা আছে, যা তাকে জানতেই হবে। সে হঠাৎ বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, "প্রকাশ, আমি না বন্ধুর বাড়িতে কাল একটা দরকারি বই ফেলে এসেছি, তুই বাড়ি যা, আমি নিয়ে আসি।" প্রকাশ কিছুটা দোনামোনা করে হাঁটা শুরু করতেই অঞ্জন দৌড়ে সোজা ভুতুড়ে বাড়িটার সামনে হাজির। কাঠের গেটটা ক্যাঁচ করে শব্দ করে খুলে সে ভেতরে ঢুকল। বেশ বড় একটা বাগান আছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আগাছা জন্মেছে সর্বত্র। কিন্তু বাগান নিয়ে সে আগ্রহী নয়। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সে একটা হলঘর দেখতে পেল। সব জায়গায় খালি পুরু ধুলোর আস্তরণ, ঝাড়বাতিগুলোও ধুলোয় ঢেকে রয়েছে। দামি দামি আসবাবপত্র রয়েছে কিছু। বোঝাই যায়, এককালে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি ছিল। হলঘরের আশেপাশের সবগুলো ঘর সে ঘুরে দেখল কিন্তু ভৌতিক কিছু তার চোখে পড়ল না। অঞ্জন মনে একটু সাহস পেল। সবই হয়ত আজগুবি গল্প।

ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখল অনেকগুলো ঘর আছে, তাদের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলোরই দরজা খোলা এবং ভেতরে উল্লেখযোগ্য কোন আসবাবপত্র নেই। তবে একটি ঘরের মেঝেতে প্রচুর পোড়া কাঠের টুকরো, ধুপকাঠি, এবং কয়েকখানা প্রদীপ পড়ে রয়েছে। এই ঘরে কি আগে পুজাআচ্চা হতো? বা তন্ত্রসাধনা? কে জানে কি ব্যাপার। এবারে অঞ্জন যে ঘরটির দরজা ভেজানো, সেটায় ধাক্কা দিল। দরজাটা খুলে যেতেই একটা হিমশীতল হাওয়ার পরশ যেন তাকে অবশ করে দিল। আর ঘরের মাঝখানে? একটি কঙ্কাল বসে রয়েছে। ঘরের পরিবেশটা যেন নিমেষে পরিবর্তিত হল। সব যেন আগের যুগে চলে যাচ্ছে, কঙ্কালটির আকৃতিতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, দেখতে দেখতে সেটায় মাংস চাপল, পোশাক পরিচ্ছদ চলে এল। ঘরের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অঞ্জন দেখল তার সামনে একটা দৈত্যাকৃতি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে, পোশাকআশাক আগেকার দিনের জমিদারবাড়ির মত, বাঁ হাতে একটা বন্দুক। চোখের দৃষ্টি? অত নিষ্ঠুর দৃষ্টি সে আজ পর্যন্ত দেখে নি। প্রতিহিংসার আগুনে চোখ দুটি যেন ধকধক করে জ্বলছে। মূর্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে পিছু হটল। নিচে নামার সিঁড়ির দিকে পিছতে লাগল। আরে, সিঁড়িটা গেল কই? এখান দিয়েই তো সে উঠেছিল। সবজায়গায় কাঠের রেলিং, কিন্তু নিচে নামার কোন পথ নেই। সামনে তাকিয়ে দেখে প্রেতমূর্তিটা তার দিকে বন্দুক তাক করছে। একটা হাড়কাঁপানো পৈশাচিক হাসির আওয়াজ সে শুনতে পেল। তার পিঠ রেলিঙে ঠেকে গেছে। সে রেলিঙে আরেকটু ভর দিতে যেতেই প্রায় একশ বছরের পুরনো ঘুণধরা কাঠের রেলিঙটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। আর অঞ্জনের দেহটা প্রায় তিরিশ ফুট নিচে মেঝের ওপর আছড়ে পড়ে দুএকবার নড়েচড়েই অসাড় হয়ে গেল। প্রেতমূর্তিটাও সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ছাড়া এখন চারদিক একদম নিস্তব্ধ।

Wednesday 10 January 2018

নারায়ণপুরের যাত্রী।

পুরোহিত হিসেবে রবীন ভটচাজের যথেষ্টই নামডাক। বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে পূজা করার জন্য তাঁর ডাক পড়ে। কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, ও দুর্গাপূজাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রচণ্ড সাহসী মানুষ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, যেই ঋতুই হোক আর যেই সময়ই হোক না কেন, তাকে ডাকলে তিনি আসেননি, এমন কোনদিনও হয়নি। তাঁর সুখ্যাতি শুনে একবার নারায়ণপুর জমিদারবাড়ি থেকে ডাক পড়ল কালীপূজা করার জন্য। কিন্তু নারায়ণপুর তাঁর গ্রাম থেকে অনেকটাই দূর, সকালে যদি রওনা হন, তবে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছাতে পারবেন। তাই তিনি সকাল সকালই যাওয়া মনস্থির করলেন। যখনকার কথা বলছি তখন যানবাহনের ব্যবস্থা এত উন্নত হয়নি। রবীনবাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটি সাইকেল, তাই চেপেই তিনি যাত্রা শুরু করলেন। যাবার সময় সেরকম কিছু উল্লেখযোগ্য না ঘটলেও একটা কালো বিড়াল রাস্তা কাটল। তিনি সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে দুবার দুর্গা দুর্গা জপ করে আবার চলতে শুরু করলেন। অনেকখানি রাস্তা, তার ওপর আকাশটা যেন একটু মেঘলা হয়ে রয়েছে।

গ্রামের মেঠো পথ, মাঝেমধ্যে দু একটা বাড়ি চোখে পড়ে, সেগুলো ছাড়ালেই আবার একটুখানি হয়ত জঙ্গল। প্রায় দুপুর হয়ে এল। পরিশ্রান্ত রবীনবাবু সাইকেল দাঁড় করিয়ে সঙ্গে যে মুড়ি জল নিয়ে বেড়িয়েছিলেন, তাই একটু খেয়ে নিলেন। গাছের তলায় একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে এল। রাস্তায় জনমানবের সংখ্যা যেন ক্রমশ কমতে লাগল। তবে তাদেরই দুএকজনকে জিজ্ঞাসা করে আশ্বস্ত হলেন যে রাস্তা ভুল হয়নি। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। তিনি জেনে নিয়েছিলেন যে নারায়ণপুর গ্রামে পৌঁছোবার আগে একটা পুরানো পরিত্যক্ত মন্দির পড়বে। হিসেবমত এতক্ষণে সেই মন্দিরের কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া উচিত। কিন্তু রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। চলছেন তো চলছেনই। অন্ধকার নামায় পথ দেখতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎই তাঁর মনে হল, ডানদিকে যেন কয়েকটা চালাঘর দেখতে পেলেন। হয়ত ওইদিকেই নারায়ণপুর পড়বে। আশান্বিত হয়ে জোরে প্যাডেলে চাপ দিলেন। ঘরগুলির কাছে পৌঁছে নেমে পড়লেন। একটা ঘরের উঠোনে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে হাঁক দিলেন, "কেউ ঘরে আছেন? এটা কি নারায়ণপুর?" কেউ কোন উত্তর দিল না। রবীনবাবু আরেকবার ডাকলেন, "কেউ আছেন ঘরে?" হঠাৎ জাদুমন্ত্রের মত তাঁর সামনে যেন একটি স্ত্রীলোক আবির্ভূত হল। "আসুন ঠাকুরমশাই। ঘরে কেউ নেই। তবে এসে যাবে।" গলাটা যেন একটু খোনা। রবীনবাবু একটু ইতস্তত করলেন। স্ত্রীলোকটি বলল, "যান আপনি ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আপনার জন্য দুটো জলখাবারের ব্যবস্থা করিগে।" অগত্যা তার কথামত ঘরে গিয়ে বসলেন। ঘরে শুধু টিমটিম করে একটা পিদিম জ্বলছে। তারই আবছা আলোয় ঘরে এদিক ওদিক কি আছে দেখার চেষ্টা করছেন, এমনই সময় স্ত্রীলোকটি ফিরে এল। আচমকা লক্ষ করলেন, তার সামনে একটা বাটিতে মুড়ি আর বাতাসা রাখা আছে, পাশে এক গেলাস জল। স্ত্রীলোকটি একটু দূরে বসে তাঁকে দেখতে লাগল। যথেষ্টই ক্ষুধার্ত ছিলেন, অতএব খেতে শুরু করলেন। কিন্তু যতই খাচ্ছেন, মুড়ি আর বাতাসা যেন ফুরাচ্ছে না। এতো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। বাধ্য হয়ে খাওয়া থামিয়ে জলের গেলাস থেকে জল খেলেন, সেখানেও একই কাণ্ড। জল খেয়ে গেলাসটা রাখা মাত্রই আবার সেটা ভর্তি হয়ে গেল। হঠাৎই একটা হাড়হিম করা হাসির আওয়াজে তিনি চমকে উঠলেন। স্ত্রীলোকটি নিমেষের মধ্যে তাঁর একদম পাশে চলে এসেছে। হাসতে হাসতে বলল, "ঠাকুরমশাই, আপনার ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটেছে তো?" রবীনবাবু কোনরকমে ঘাড় নাড়লেন। স্ত্রীলোকটির মুখের হাসি যেন পলকের মধ্যে মুছে গেল, সারা মুখে একটা ভয়াল জিঘাংসাপূর্ণ দৃষ্টি। "এবার আমার তৃষ্ণা কে মেটাবে?" বলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রবীনবাবুকে জাপটে ধরল। রবীনবাবু যথেষ্ট শক্তিশালী মানুষ, কিন্তু স্ত্রীলোকটির শক্তি যেন তাঁর চারগুণ। কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না, দম আটকে এল। ঘাড়ের ওপর স্ত্রীলোকটির হিমশীতল নিঃশ্বাস পড়ছে আর দুটি ছুঁচের মত ধারালো কিছু যেন তাঁর চামড়াকে স্পর্শ করছে। আস্তে আস্তে সে দুটি ফলা যেন তাঁর ঘাড়ে প্রবেশ করছে, রবীনবাবু অনুভব করলেন তাঁর পরনের পাঞ্জাবিটা যেন ভিজে যাচ্ছে। রক্ত? জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে মনে হল যেন একটা ভয়ংকর মিশকালো প্রেতমূর্তি তাঁর বুকের ওপর বসে রক্তপিপাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে।