Pages

Finance and Travel Ideas

Tuesday 30 January 2018

আলেয়া।

বদলির চিঠিটা হাতে পেয়েই সাব পোস্টমাস্টার রতনবাবু রওনা হওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। এবার গন্তব্যস্থল মদনপুর, শিয়ালদহ রাণাঘাট লাইনে কল্যাণীর ঠিক পরের স্টেশন। স্টেশনে নেমে কাছেই একটা সাব পোস্টঅফিসে তার নতুন দায়িত্ব। কোয়ার্টারেই থাকাখাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা।
অকৃতদার মানুষ, তাই বদলির চাকরিতে তার খুব একটা আপত্তি নেই। বরং তার বেশ ভালই লাগে নতুন জায়গায় ঘুরতে এবং নতুন নতুন মানুষজনের সঙ্গে মিশতে। অতএব তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়েই পড়লেন। পরের দিন সকালেই দায়িত্ব সব বুঝে নিতে হবে। শিয়ালদহ থেকে রাত সাড়ে নটার রাণাঘাট লোকালটা ধরে নিলেন। মদনপুর পৌঁছাতে এক ঘণ্টার একটু হয়তো বেশীই লাগবে। ট্রেনে অফিস্ ফেরতা মানুষের প্রচুর ভিড়, তবে নৈহাটি ও কল্যাণীতে অনেকেই নেমে গেল। মদনপুর পৌঁছে কথাই ছিল, নতুন সাব পোস্টঅফিসের পিওন তাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দেবে। সে একটা সাইকেল নিয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌতূহলী রতনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি। সে বলল, "হুজুর, কাল রাত থেকে মায়ের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, কিছুতেই কমছে না। ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হবে, সেও অনেকটা রাস্তা। এদিকে আপনিও আসবেন বলে অপেক্ষা করে আছি। কি করব, বুঝতে পারছি না।" রতনবাবু তাকে অভয় দিয়ে বললেন, "চিন্তা নেই, তুমি রাস্তাটা আমাকে বলে দাও, আমি একাই যেতে পারব। তুমি বরং ডাক্তারবাবুকে নিয়ে মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। ওটা বেশি জরুরী।" পিওন তাও যেন একটু ইতস্তত করছিল, তাকে এক ধমক দিয়ে রওনা করে দিলেন। যাবার সময় পিওনটি তাকে সাইকেলটা দিয়ে বলল, "হুজুর, স্টেশন রোড ছাড়িয়ে একটু গেলে ধানক্ষেত, ওই ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে রাস্তা, সোজা চলে যাবেন। পথে ডানদিকে একটা জলা পড়বে। জায়গাটা ভাল না। লোকে বলে নাকি ডাইনী আছে। কয়েকটা খুনখারাপিও হয়েছে ওখানে। তবে যদি কিছু অদ্ভুত দেখেন, সাইকেল দাঁড় করাবেন না। জলা পেরিয়ে কাউকে একটু জিজ্ঞাসা করবেন, পোস্টঅফিসের কোয়ার্টার যে কেউ দেখিয়ে দেবে।" সেইমত রতনবাবু সাইকেলে উঠে পড়লেন। সঙ্গে শুধু একটা ব্যাগ, সেটা ক্যারিয়ারে বেঁধে নিলেন। সাইকেলে লাইট আছে দেখে খুশিই হলেন। গ্রামের রাস্তা, তেমন আলো নেই। তার সুবিধাই হবে।

আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে মৃদুমন্দ চালে সাইকেল চালিয়ে চলেছেন রতনবাবু। মনে বেশ ফুর্তি। তার হঠাৎ কলেজ্ জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। সাইকেল করে ঘুরে বেড়ানো তার প্রিয় শখগুলির অন্যতম আর এটা সেই কলেজজীবন থেকেই শুরু। কত নির্জন জায়গায় রাত বিরেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কখনো ভয় পাননি। আসলে ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব সাহসী ও অ্যাডভেনচারাস প্রকৃতির। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে শ্মশানেও রাত্রিবেলা অনেকবার গেছেন কিন্তু ভয় পাওয়ার মত কিছু অভিজ্ঞতা তার হয়নি। পথে এক আধজন কে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে বুঝতে পারলেন, ঠিক পথেই চলেছেন।
একটু দূরে জলে হালকা চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখে বুঝতে পারলেন, জলাটার কাছে প্রায় এসে পড়েছেন। জলাটা খুব বেশি বড় নয়, পেরিয়ে যেতে তার বেশি সময় লাগবে না। তবে আশপাশটা যেন একদম নির্জন। হঠাৎই দপ করে জলার মাঝখানে যেন একটা আলো জ্বলে উঠল। এত রাতে কে ওখানে আলো জ্বালাবে? কৌতূহল হওয়ায় রতনবাবু সাইকেল দাঁড় করালেন। আস্তে আস্তে জলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। কই, কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। ওই, আবার সেই আলো! এবার যেন আরেকটু কাছে। জলের একটু উপরে, জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছে। আলেয়া নয় তো? রতনবাবু পড়েছেন, জলাভুমিতে এরকম নাকি রাত্রিবেলা গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের উৎপত্তি হয়, তার থেকে আলেয়া দেখা যায়। সেই দেখে অনেকে ভুত ভেবে ভয়ও পায়। আবার, আবার সেই আলো। আলোটা যেন চুম্বকের মত তাকে টানছে। এগিয়ে আসছে আলোটা, রতনবাবুও যেন সম্মোহিতের মত কাদা পাঁক ঠেলে এগিয়ে চলেছেন। সাইকেলটা পড়ে থাকল। তার কোন হুঁশ নেই। কোমর অবদি ডুবে গেল তার। প্রায় জলার মাঝামাঝি চলে এসেছেন। তাকে কে যেন টানছে নিচ থেকে। এতো মানুষের হাতের স্পর্শ নয়। মানুষের হাত কি এত শীতল আর শক্ত হয়? গলা, নাক সবই
পাঁকে ডুবে গেল তার। আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। কোন প্রতিরোধও করছেন না। চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে। নিশ্বাস নেওয়া দুরুহ ব্যাপার হয়ে পড়ছে। চোখের ওপর যেন কেউ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে যেন গলায় একটা হিমশীতল কঙ্কালের হাতের স্পর্শ......বড়ই নিষ্ঠুর, বড়ই ভয়ংকর সে স্পর্শ।

পরের দিন সকালে রতনবাবুর নিথর দেহটা জলার মাঝখান থেকে উদ্ধার করা হল। যে পিওনটির তাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, সে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সাহেবকে বারণ করেছিলাম, যদি কিছু অদ্ভুত দেখেন, জলার কাছে দাঁড়াবেন না। নিশ্চয়ই উনি শোনেননি।“ আশেপাশের লোকজন কথাটা শুনে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে যেন একটা অশুভ ফিসফিসানি ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

Tuesday 16 January 2018

হানাবাড়ি।

অঞ্জনদের পাড়ায় একটা খুব পুরনো বাড়ি আছে। ওই বাড়ির লোকেরা নাকি এককালে খুব ধনী ছিল। এখন তাদের বংশধরেরা কেউই আর নেই। বাড়িটার দেখাশোনা করা বহুদিন ধরেই বন্ধ। বাড়িটার সম্পর্কে লোকজনের কৌতূহলের অন্ত নেই। কিন্তু বাড়িটা ভুতুড়ে বলে কেউ বাড়িটার ধারকাছ মাড়ায় না।
ছোটবেলা থেকেই অঞ্জনের খুব আগ্রহ বাড়িটার প্রতি। শুধু তার বাড়ির লোকেদের বারণের কারণেই সে বাড়িটায় কোনদিন ঢোকেনি। সেদিন তাড়াতাড়ি হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে গেল। সে আর তার প্রিয় বন্ধু প্রকাশ বাড়ি ফিরছিল। বাড়িটা তাদের স্কুল থেকে ফেরার পথেই পড়ে। হঠাৎই অঞ্জন প্রকাশকে জিজ্ঞাসা করল, "হ্যাঁরে, এই পোড়ো বাড়িটা সম্বন্ধে তুই কিছু জানিস?" প্রকাশ সন্দিগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, "তেমন কিছু না। তবে বাড়িটা অভিশপ্ত। ওই বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন, তিনি নাকি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছিলেন। গুলি চালিয়ে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলে নিজেও আত্মহত্যা করেন। কেন?" অঞ্জন বলল, "না, ভাবছি বাড়িটার ভিতরে একদিন ঢুকে দেখব কি আছে।" প্রকাশ ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, "না না, একদম না। ওই চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দে। ওটা ভুতুড়ে। চল বাড়ি যাই।" তার কথামত সঙ্গে কিছুটা গিয়ে অঞ্জন অনুভব করল বাড়িটা যেন তাকে তীব্রভাবে টানছে। ওই বাড়িটায় কিছু যেন একটা আছে, যা তাকে জানতেই হবে। সে হঠাৎ বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, "প্রকাশ, আমি না বন্ধুর বাড়িতে কাল একটা দরকারি বই ফেলে এসেছি, তুই বাড়ি যা, আমি নিয়ে আসি।" প্রকাশ কিছুটা দোনামোনা করে হাঁটা শুরু করতেই অঞ্জন দৌড়ে সোজা ভুতুড়ে বাড়িটার সামনে হাজির। কাঠের গেটটা ক্যাঁচ করে শব্দ করে খুলে সে ভেতরে ঢুকল। বেশ বড় একটা বাগান আছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আগাছা জন্মেছে সর্বত্র। কিন্তু বাগান নিয়ে সে আগ্রহী নয়। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সে একটা হলঘর দেখতে পেল। সব জায়গায় খালি পুরু ধুলোর আস্তরণ, ঝাড়বাতিগুলোও ধুলোয় ঢেকে রয়েছে। দামি দামি আসবাবপত্র রয়েছে কিছু। বোঝাই যায়, এককালে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি ছিল। হলঘরের আশেপাশের সবগুলো ঘর সে ঘুরে দেখল কিন্তু ভৌতিক কিছু তার চোখে পড়ল না। অঞ্জন মনে একটু সাহস পেল। সবই হয়ত আজগুবি গল্প।

ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখল অনেকগুলো ঘর আছে, তাদের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলোরই দরজা খোলা এবং ভেতরে উল্লেখযোগ্য কোন আসবাবপত্র নেই। তবে একটি ঘরের মেঝেতে প্রচুর পোড়া কাঠের টুকরো, ধুপকাঠি, এবং কয়েকখানা প্রদীপ পড়ে রয়েছে। এই ঘরে কি আগে পুজাআচ্চা হতো? বা তন্ত্রসাধনা? কে জানে কি ব্যাপার। এবারে অঞ্জন যে ঘরটির দরজা ভেজানো, সেটায় ধাক্কা দিল। দরজাটা খুলে যেতেই একটা হিমশীতল হাওয়ার পরশ যেন তাকে অবশ করে দিল। আর ঘরের মাঝখানে? একটি কঙ্কাল বসে রয়েছে। ঘরের পরিবেশটা যেন নিমেষে পরিবর্তিত হল। সব যেন আগের যুগে চলে যাচ্ছে, কঙ্কালটির আকৃতিতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, দেখতে দেখতে সেটায় মাংস চাপল, পোশাক পরিচ্ছদ চলে এল। ঘরের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অঞ্জন দেখল তার সামনে একটা দৈত্যাকৃতি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে, পোশাকআশাক আগেকার দিনের জমিদারবাড়ির মত, বাঁ হাতে একটা বন্দুক। চোখের দৃষ্টি? অত নিষ্ঠুর দৃষ্টি সে আজ পর্যন্ত দেখে নি। প্রতিহিংসার আগুনে চোখ দুটি যেন ধকধক করে জ্বলছে। মূর্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে পিছু হটল। নিচে নামার সিঁড়ির দিকে পিছতে লাগল। আরে, সিঁড়িটা গেল কই? এখান দিয়েই তো সে উঠেছিল। সবজায়গায় কাঠের রেলিং, কিন্তু নিচে নামার কোন পথ নেই। সামনে তাকিয়ে দেখে প্রেতমূর্তিটা তার দিকে বন্দুক তাক করছে। একটা হাড়কাঁপানো পৈশাচিক হাসির আওয়াজ সে শুনতে পেল। তার পিঠ রেলিঙে ঠেকে গেছে। সে রেলিঙে আরেকটু ভর দিতে যেতেই প্রায় একশ বছরের পুরনো ঘুণধরা কাঠের রেলিঙটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। আর অঞ্জনের দেহটা প্রায় তিরিশ ফুট নিচে মেঝের ওপর আছড়ে পড়ে দুএকবার নড়েচড়েই অসাড় হয়ে গেল। প্রেতমূর্তিটাও সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ছাড়া এখন চারদিক একদম নিস্তব্ধ।

Wednesday 10 January 2018

নারায়ণপুরের যাত্রী।

পুরোহিত হিসেবে রবীন ভটচাজের যথেষ্টই নামডাক। বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে পূজা করার জন্য তাঁর ডাক পড়ে। কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, ও দুর্গাপূজাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রচণ্ড সাহসী মানুষ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, যেই ঋতুই হোক আর যেই সময়ই হোক না কেন, তাকে ডাকলে তিনি আসেননি, এমন কোনদিনও হয়নি। তাঁর সুখ্যাতি শুনে একবার নারায়ণপুর জমিদারবাড়ি থেকে ডাক পড়ল কালীপূজা করার জন্য। কিন্তু নারায়ণপুর তাঁর গ্রাম থেকে অনেকটাই দূর, সকালে যদি রওনা হন, তবে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছাতে পারবেন। তাই তিনি সকাল সকালই যাওয়া মনস্থির করলেন। যখনকার কথা বলছি তখন যানবাহনের ব্যবস্থা এত উন্নত হয়নি। রবীনবাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটি সাইকেল, তাই চেপেই তিনি যাত্রা শুরু করলেন। যাবার সময় সেরকম কিছু উল্লেখযোগ্য না ঘটলেও একটা কালো বিড়াল রাস্তা কাটল। তিনি সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে দুবার দুর্গা দুর্গা জপ করে আবার চলতে শুরু করলেন। অনেকখানি রাস্তা, তার ওপর আকাশটা যেন একটু মেঘলা হয়ে রয়েছে।

গ্রামের মেঠো পথ, মাঝেমধ্যে দু একটা বাড়ি চোখে পড়ে, সেগুলো ছাড়ালেই আবার একটুখানি হয়ত জঙ্গল। প্রায় দুপুর হয়ে এল। পরিশ্রান্ত রবীনবাবু সাইকেল দাঁড় করিয়ে সঙ্গে যে মুড়ি জল নিয়ে বেড়িয়েছিলেন, তাই একটু খেয়ে নিলেন। গাছের তলায় একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে এল। রাস্তায় জনমানবের সংখ্যা যেন ক্রমশ কমতে লাগল। তবে তাদেরই দুএকজনকে জিজ্ঞাসা করে আশ্বস্ত হলেন যে রাস্তা ভুল হয়নি। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। তিনি জেনে নিয়েছিলেন যে নারায়ণপুর গ্রামে পৌঁছোবার আগে একটা পুরানো পরিত্যক্ত মন্দির পড়বে। হিসেবমত এতক্ষণে সেই মন্দিরের কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া উচিত। কিন্তু রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। চলছেন তো চলছেনই। অন্ধকার নামায় পথ দেখতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎই তাঁর মনে হল, ডানদিকে যেন কয়েকটা চালাঘর দেখতে পেলেন। হয়ত ওইদিকেই নারায়ণপুর পড়বে। আশান্বিত হয়ে জোরে প্যাডেলে চাপ দিলেন। ঘরগুলির কাছে পৌঁছে নেমে পড়লেন। একটা ঘরের উঠোনে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে হাঁক দিলেন, "কেউ ঘরে আছেন? এটা কি নারায়ণপুর?" কেউ কোন উত্তর দিল না। রবীনবাবু আরেকবার ডাকলেন, "কেউ আছেন ঘরে?" হঠাৎ জাদুমন্ত্রের মত তাঁর সামনে যেন একটি স্ত্রীলোক আবির্ভূত হল। "আসুন ঠাকুরমশাই। ঘরে কেউ নেই। তবে এসে যাবে।" গলাটা যেন একটু খোনা। রবীনবাবু একটু ইতস্তত করলেন। স্ত্রীলোকটি বলল, "যান আপনি ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আপনার জন্য দুটো জলখাবারের ব্যবস্থা করিগে।" অগত্যা তার কথামত ঘরে গিয়ে বসলেন। ঘরে শুধু টিমটিম করে একটা পিদিম জ্বলছে। তারই আবছা আলোয় ঘরে এদিক ওদিক কি আছে দেখার চেষ্টা করছেন, এমনই সময় স্ত্রীলোকটি ফিরে এল। আচমকা লক্ষ করলেন, তার সামনে একটা বাটিতে মুড়ি আর বাতাসা রাখা আছে, পাশে এক গেলাস জল। স্ত্রীলোকটি একটু দূরে বসে তাঁকে দেখতে লাগল। যথেষ্টই ক্ষুধার্ত ছিলেন, অতএব খেতে শুরু করলেন। কিন্তু যতই খাচ্ছেন, মুড়ি আর বাতাসা যেন ফুরাচ্ছে না। এতো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। বাধ্য হয়ে খাওয়া থামিয়ে জলের গেলাস থেকে জল খেলেন, সেখানেও একই কাণ্ড। জল খেয়ে গেলাসটা রাখা মাত্রই আবার সেটা ভর্তি হয়ে গেল। হঠাৎই একটা হাড়হিম করা হাসির আওয়াজে তিনি চমকে উঠলেন। স্ত্রীলোকটি নিমেষের মধ্যে তাঁর একদম পাশে চলে এসেছে। হাসতে হাসতে বলল, "ঠাকুরমশাই, আপনার ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটেছে তো?" রবীনবাবু কোনরকমে ঘাড় নাড়লেন। স্ত্রীলোকটির মুখের হাসি যেন পলকের মধ্যে মুছে গেল, সারা মুখে একটা ভয়াল জিঘাংসাপূর্ণ দৃষ্টি। "এবার আমার তৃষ্ণা কে মেটাবে?" বলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রবীনবাবুকে জাপটে ধরল। রবীনবাবু যথেষ্ট শক্তিশালী মানুষ, কিন্তু স্ত্রীলোকটির শক্তি যেন তাঁর চারগুণ। কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না, দম আটকে এল। ঘাড়ের ওপর স্ত্রীলোকটির হিমশীতল নিঃশ্বাস পড়ছে আর দুটি ছুঁচের মত ধারালো কিছু যেন তাঁর চামড়াকে স্পর্শ করছে। আস্তে আস্তে সে দুটি ফলা যেন তাঁর ঘাড়ে প্রবেশ করছে, রবীনবাবু অনুভব করলেন তাঁর পরনের পাঞ্জাবিটা যেন ভিজে যাচ্ছে। রক্ত? জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে মনে হল যেন একটা ভয়ংকর মিশকালো প্রেতমূর্তি তাঁর বুকের ওপর বসে রক্তপিপাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে।