Pages

Finance and Travel Ideas

Wednesday 28 February 2018

একলব্যের গুরুদক্ষিণা।

সবাই  তো  জানেন  যে  মধ্যম  পাণ্ডব  অর্জুন  একজন  অসাধারণ  তীরন্দাজ  ছিলেন। কিন্তু  অর্জুনের  থেকেও  একজন  দক্ষ  তীরন্দাজের  উল্লেখ  আছে  মহাভারতে।  তার  নাম  একলব্য।  একলব্য  ছিলেন  নিষাদ বংশের  সন্তান  অর্থাৎ ব্যাধ।  একলব্যের মনে প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল দ্রোণাচার্যের  কাছে অস্ত্রশিক্ষা নেবেন। কিন্তু দ্রোণাচার্য তাকে আশ্রম থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত নয় বলে। এর ফলে তিনি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। যে মাটির ওপর দিয়ে দ্রোণাচার্য হেঁটে গেছিলেন সেই মাটি দিয়ে গুরু দ্রোণাচার্যের মূর্তি বানিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। সেই মূর্তিকেই গুরু মানলেন এবং তীর ধনুক চালানো অভ্যাস করতে লাগলেন। শৃঙ্খলা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্রমে তিনি অর্জুনের থেকেও দক্ষ তীরন্দাজ হয়ে উঠলেন। কোন প্রাণীকে না দেখে শুধুমাত্র তার আওয়াজ শুনেই তাকে তীরবিদ্ধ করতে পারতেন। একটি  কুকুর তাকে অস্ত্রসাধনার সময় ঘেউ ঘেউ করে ডেকে বিরক্ত করত। তিনি তীর দিয়ে তার মুখটাকে এমনভাবে শরবিদ্ধ করে দিলেন যে সে আর ডাকতে পারবে না কিন্তু মরবেও না।

একদা গুরু দ্রোণাচার্যের  সঙ্গে কৌরব ও পাণ্ডব রাজকুমারেরা বনের মধ্যে অস্ত্র শিক্ষা করছিলেন। যে যার নিজের নিজের অভ্যাসে মন দিয়েছেন সবাই। এমন সময় একটি কুকুরকে আসতে দেখে সবাই হতবাক হয়ে যান । কারণ সেই কুকুরের মুখ ছিল বেশ কয়েকটি শরবিদ্ধ! মুখে অতগুলো তীর গেঁথে থাকার পরেও কুকুরটি বেঁচে আছে কী করে, সেই ভাবনায় অস্থির হলেন সবাই এবং বুঝতে পারলেন, যেই ব্যাক্তি এমন কাজ করতে পারেন তিনি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর! এর পরেই সশিষ্য গুরু দ্রোণাচার্য বনের গভীরে প্রবেশ করলেন। পাণ্ডবেরা একলব্যকে খুঁজে বার করলেন এবং অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কার কাছে অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেছ?" উত্তরে একলব্য বললেন, "দ্রোণাচার্য।" রাগে কাঁপতে কাঁপতে অর্জুন ফিরে এলেন এবং দ্রোণাচার্যকে বললেন, "আপনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আপনার আমাকে বিশেষভাবে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তা না করে আপনি অন্য আরেকজনকে তীরন্দাজি শিখিয়েছেন এবং আমার থেকেও দক্ষ বানিয়েছেন।" দ্রোণ অবাক হয়ে গেলেন এবং বুঝতে পারলেন না অর্জুন কার কথা বলছেন। যাই হোক, তিনি অর্জুনকে সাথে নিয়ে একলব্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। একলব্য তাঁদের দুজনকেই স্বাগত জানালেন। সেই মূর্তির কাছে নিয়ে গেলেন যাকে গুরু মেনে দিনের পর দিন তিনি অভ্যাস করেছেন। তখন দ্রোণাচার্য বললেন, "আমি মনে করেছিলাম অর্জুন আমার শ্রেষ্ঠ শিষ্য। কিন্তু এখন দেখছি তুমিই আমার শ্রেষ্ঠ শিষ্য এবং অর্জুনের থেকে অনেক বেশী দক্ষ তীরন্দাজ।" তখন একলব্য শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, "গুরুদেব, আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?" তখন দ্রোণাচার্য উত্তর দিলেন, "আমাকে গুরু মেনে যখন তুমি এতটা দক্ষতা অর্জন করেছ, আমি গুরুদক্ষিণা হিসাবে তোমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি চাইছি।" একলব্য জানতেন যে তিনি যদি গুরুদক্ষিণা হিসাবে তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি দেন তাহলে তিনি আর তীর ধনুক চালাতে পারবেন না। তবুও নির্দ্বিধায় তিনি ছুরি বার করে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি কেটে দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দিলেন। অর্জুনও মনে মনে খুশি হলেন যে তার আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।

একলব্যকে শিষ্য হিসাবে প্রথমেই যদি দ্রোণাচার্য গ্রহণ করতেন তাহলে মহাভারতের কাহিনী হয়ত কিছুটা ভিন্ন হতো।

Sunday 25 February 2018

বর্ষার সেই রাত।

ছোটবেলা থেকেই অর্ণবের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। পড়াশোনায় সে খুব ভালো ছিল বলে সেই স্বপ্ন তার পূরণও হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে সে খুব ভালো নম্বর পেয়ে সে এমবিবিএস পাশ করেছে। কিন্তু এবার ইন্টার্নশিপের জন্য তাকে এক বছর কলকাতার বাইরে কোন হাসপাতালে গিয়ে কাজ করতে হবে। ক্যানিং এর বাসন্তী ব্লকে তার পোস্টিং পড়ল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে রওনা হল। নতুন হাসপাতালের দায়িত্ব তার ভালই লাগল। সিনিয়ররা এবং সহকর্মীরা বেশ ভালো। গ্রামের লোকজনেরও ডাক্তারবাবুদের ওপর অগাধ বিশ্বাস। অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল অর্ণব। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাঝে মধ্যেই তাকে বসতে হয় এবং তার কাছে জ্বরজারি বিবিধ সমস্যা নিয়ে লোকেরা আসে এবং সে সাধ্যমত তাদের রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করে। এইভাবে চলছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎই এমন একটা ঘটনা অর্ণবের জীবনে ঘটল যুক্তিতে যার কোন ব্যাখা মিলবেনা।

বর্ষাকাল চলছে। সারাদিন ধরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সন্ধেবেলা ডিউটি থেকে ফিরে অর্ণব একটু মুড়ি চানাচুর নিয়ে বসেছে, হঠাৎই সদর দরজাটা কে যেন সজোরে ধাক্কাতে আরম্ভ করল, "ডাক্তারবাবু, বাড়িতে আছেন? দয়া করে দরজাটা খুলুন।" অর্ণব খুব বিরক্ত বোধ করল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর একটু বিশ্রামের অবকাশ, তাও উপায় নেই। সে বলল, "আমি খুবই ক্লান্ত। তাছাড়া আমাদের হাসপাতালের বাইরে প্র্যাকটিস করা নিয়ম নেই, আপনি এখন যান।" কিন্তু নাছোড়বান্দা কণ্ঠস্বরটি বলল, "হুজুর, একবার চলুন, আমার বাবার ধুম জ্বর, কিছুতেই কমছে না। বাড়ি বেশি দূর না, আর কাউকে পেলাম না বলে আপনার কাছেই এলাম।" অর্ণব আরও দুএকবার আপত্তি করল, কিন্তু লোকটি কিছুতেই শুনল না। অগত্যা সে দরজাটা খুলল। দরজা খুলতে না খুলতেই কড়কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেটুকু দেখতে পেল তাতে মনে হল রোগাপাতলা চেহারার একটি মাঝবয়সী গ্রাম্য লোক, আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা, মুখটাও ভালো করে খেয়াল করা যাচ্ছে না। সে চট করে একটা ছাতা আর তার ডাক্তারি সরঞ্জামের ব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে লোকটির পিছন পিছন চলতে লাগল। একে তো অন্ধকার গ্রামের রাস্তা, তার ওপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, যেন সামনের লোকটি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। লোকটি এতো দ্রুতগতিতে হাঁটছে যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না, খালি পিছিয়ে পড়ছে। তখন একটু হাঁকডাক দিয়ে  নিশ্চিত হচ্ছে যে লোকটি সঙ্গে আছে। বেশ কিছুটা পথ চলার পরে দূরে যেন একটা চালাঘর দেখা গেল। পথপ্রদর্শক লোকটি বলল, "ডাক্তারবাবু, আমাদের বাড়ি এসে গেছে।" আবার একটা বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেটুকু দেখা গেল, লোকটি আর তার পাশে নেই। চমকে গিয়ে অর্ণব ডাকতে লাগল, "ও মশাই, কোথায় গেলেন, ও মশাই?" লোকটি যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। বাধ্য হয়েই সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে চালাঘরটির দিকেই এগোতে লাগল। চালাঘরটির কাছে পৌঁছে দেখল যেন বিছানায় কেউ শুয়ে রয়েছে এবং আশেপাশে আরও কয়েকটি ছায়ামূর্তি ঘোরাফেরা করছে। অন্ধকারে কারোরই মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। অর্ণবকে দেখে কে যেন বলে উঠল, "বড় দেরি করে ফেললেন ডাক্তারবাবু, আর বোধহয় বাঁচবে না।" মহিলার গলায় একটা বুকফাটা কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। অর্ণবের কাছে সবই যেন কেমন ধোঁয়াশার মত লাগছে, তবুও একজন ডাক্তারের কর্তব্য পালনার্থে সে রোগীর পাশে বসে তার নাড়িটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু একি? চাদরের তলা থেকে যে হাতটি সে তুলে ধরল, তার স্পর্শ এত ঠাণ্ডা কেন? এতো রক্তমাংসের হাত নয়। এতো কংকালের হাত! আর তার চারপাশে কারা ভিড় করে এগিয়ে আসছে? এরা কি মানুষ? মানুষ এমন হয়? মনে হচ্ছে গায়ে চাদর জড়ানো একদল কংকাল, শুধু খুলিগুলো দেখা যাচ্ছে। সেগুলো যেন বীভৎসভাবে হাসতে হাসতে অর্ণবের দিকে চেয়ে বলছে, "আর তোর রক্ষা নেই, আজ আর তুই বাঁচলি না।" ছায়ামূর্তিগুলোর অন্ধকার তাকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই অর্ণব জ্ঞান হারাল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন এখন আরও জোরে জোরে পড়ছে।

পরের দিন সকালে গ্রামবাসীরা অর্ণবের মৃতদেহটা উদ্ধার করল। সারা শরীরে যেন এক ফোঁটাও রক্ত অবশিষ্ট নেই, কেউ যেন শুষে নিয়েছে। চোখগুলো যেন মরার আগের মুহূর্তে ভয়ংকর কিছু দেখে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। বহু বছর আগে ওই একই দিনে ওই জায়গায় বেশ কিছু লোক মহামারীতে মারা গেছিল। তারপর থেকে নাকি জায়গাটা অভিশপ্ত।

Monday 19 February 2018

মানিক মাঝির গল্প।

গ্রামের নাম কুসুমপুর। রাত অনেক। কিন্তু মানিক মাঝির চোখে ঘুম নেই। এভাবে চলতে থাকলে ভিটেমাটি সবই যাবে। পথে বসতে হবে পরিবার নিয়ে। মাছের ব্যবসায় যে এত মন্দা হবে, কে ভেবেছিল। আশেপাশের গ্রাম থেকে দুএকটা আত্মহত্যার খবর যখন কানে আসে, শরীরটা শিউড়ে ওঠে। পাশে বউ ছন্দা আর ছেলে ভুতো ঘুমিয়ে। মানিক উঠে বসল। ভবিষ্যতে কি করবে ভাবতে থাকে। সংসার চালানো, ছেলের পড়াশোনা। একে তো পুকুরগুলোতে সেইভাবে মাছ উঠছে না, তার উপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত নরেন ব্যবসার অনেকগুলো টাকা মেরে তাকে আরও বসিয়ে দিয়ে গেছে। কি উপায়? শুনশান রাত। দূরে মনে হয় একটা শেয়াল ডাকছে। মানিক ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে চোখটা যেন লেগে আসে প্রায়। সারাদিনের ক্লান্তির জন্য হয়ত।
হঠাৎ একটা চিন্তা তার মাথায় আসে। কাজটায় বেশ ঝুঁকি আছে। কিন্তু এছাড়া তার হয়ত উপায়ও নেই। ডুমুরজলা বলে গ্রামের যে জলাটা আছে, সেখানে রাত্তির করে মাছ ধরলে কেমন হয়? এক সময় অনেক মাছ পাওয়া যেত, আর রাতের বেলা কোন লোক থাকবে না, যা পাওয়া যাবে সবই তার। কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা বলে জলাটায় নাকি অপদেবতা আছে। আগেও রাতে মাছ ধরতে যাবার কথা ওঠায় অনেকেই বারণ করেছে। 'তেনাদের' অনেকেই ভয় পায় বটে। কিন্তু মানিক এখন মরিয়া। অভাবের তাড়নার জন্যই হয়ত। চকিতে ছিপ, গামছা, আর মাছের থলেটা বগলদাবা করে বেরিয়েই পড়ে মানিক। ঘুমের ঘোরেই যেন একটু পাশ ফিরে শোয় ছন্দা। তার বেরিয়ে যাওয়াটা টের পায় না।

হনহন করে হাঁটতে থাকে মানিক। তার ঘর থেকে জলা নেহাত কম দূর নয়। ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না। জলায় পৌঁছে একটা গাছের তলায় বসে জলে ছিপ ফেলে। চারদিকে বেশ চাঁদের আলো আছে। নাহ, বুদ্ধিটা খারাপ নয়, রুই, পোনা, কই, এটা ওটা উঠতেই লাগল। মানিকের মনে আনন্দ আর ধরে না। অনেকদিন পর সে ছন্দা আর ভুতোর মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারবে। আর গোটাকয়েক হলেই হবে। উল্লসিত মনে মানিক ছিপ ফেলে। এবারে মনে হয় বড় মাছ। ওরেব্বাস, কি ভারি মাইরি! ছিপ বেঁকে যাচ্ছে। মানিকও ছাড়বে না, হার মানবার পাত্র নয়। ছিপ ধরে টানতে থাকে। মাছটা অসম্ভব ভারি। মাছই তো? না অন্য কিছু? সে সমস্ত শক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে টান মারে। কি একটা যেন ফুটবলের মত জিনিস জল থেকে ছিটকে উঠে আসে। মানিক টাল সামলাতে না পেরে আছাড় খেয়ে পড়ে। পড়বি তো পড় জিনিসটা তার মাথার পাশেই পড়ে। কি ওটা? একি দেখছে মানিক? এতো একটা কাটা মুণ্ডু! আর মূখটা অবিকল তারই মতো। তফাৎ শুধু এইটাই, মুণ্ডুটার আগুনে চোখগুলো বীভৎসভাবে বিস্ফারিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রয়েছে আর ঠোঁটের দুই কোণ দিয়ে দুটো ধারালো দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, যা বেয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। একটা রক্ত জল করা হাসির শব্দ শুনতে পেল মানিক। তার আর কিছু মনে নেই।
ভোরবেলা গাঁয়ের লোকেরা মানিকের মৃতদেহটা জলার ধার থেকে উদ্ধার করল। শরীর থেকে সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিয়েছে। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। রহিম খুড়ো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, "ছাওয়ালটারে অনেক বারণ করসিলাম, শুনল না।" ছন্দা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একটা বুকফাটা আর্তনাদ করে নিথর দেহটার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল।

Tuesday 13 February 2018

শেষ ট্রেনের যাত্রী।

অফিসের কাজ শেষ করতে করতে বেশ দেরিই হল সুমন্ত্রের। একেই উইকএণ্ড, তার ওপর কাজ জমিয়ে রাখা একদমই পছন্দ না তার। অতএব দেরি। তড়িঘড়ি স্টেশনের দিকে রওনা হল সে। লাস্ট ট্রেনটা মিস করলে রাতটা প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে কাটাতে হবে, যেটা মোটেও সুমন্ত্রের পছন্দ না। ভাগ্যক্রমে ট্রেনটা পেয়েই গেল সে। কামরাতে উঠেই জানলার ধারে একটা সিটে বসে পড়ল। স্টেশনের নাম ভুদেবপুর (কাল্পনিক), শিয়ালদহ থেকে পাক্কা দুঘণ্টার পথ। স্টেশন থেকে তার বাড়ি হেঁটে গেলে ১০-১২ মিনিটের রাস্তা, আর রিকশায় চাপলে ৪-৫ মিনিট। কিন্তু স্টেশনে নামতে না নামতেই ঝমঝম করে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। ভুল করে সকালে আকাশ পরিস্কার দেখে ছাতাটাও আনেনি সে। তাই তাকে ভিজতেই হল। রিকশার জন্য আর সে অপেক্ষা না করে হেঁটেই রওনা হল। বৃষ্টির জন্য স্টেশন চত্বর একদমই ফাঁকা। ডেলি পাসেঞ্জারি করে বলে প্রত্যেকদিনই কাউকে না কাউকে সহযাত্রী হিসেবে পেয়েই যায় সে। কারো কারো বাড়ি তার বাড়ির রাস্তার পথেই। কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা। সে একাই স্টেশনে নেমেছে। কোনরকমে রুমালটা দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

আজ মনে হয় অমাবস্যা, চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ চলার পর বৃষ্টিটা একটু ধরল। স্টেশন পেরিয়ে ডানদিকে একটা বিরাট মাঠ পড়ে, মাঠের লাগোয়া শ্মশানও আছে। রাতে ওই জায়গাটা সবাই এড়িয়েই চলে। অনেক রকম অদ্ভুত আওয়াজ নাকি শোনা যায়। তবে সুমন্ত্র সাহসী মানুষ, এসব খুব একটা পাত্তা দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে মাঠটা প্রায় অতিক্রম করে এসেছে, হঠাৎ মনে হল কেউ তার পিছন পিছন আসছে। পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল লম্বা মতন কে হেঁটে আসছে। হয়ত তাদের গ্রামেরই কেউ।হঠাৎই মনে পড়ল, ওদের পাড়ার ভবতোষদা বেশ লম্বা, সেই নয় তো? ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞাসা করল, "ভবতোষদা নাকি? এত রাতে? কোথা থেকে ফিরলেন?" কিন্তু কোন উত্তর নেই। আর লোকটা যেন চলার বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। এবার কিন্তু সুমন্ত্র একটু ভয় পেল। সেও চলার গতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ওকি! লোকটা যেন ক্রমশ আরও লম্বা হচ্ছে। আরও কাছে আসছে। সুমন্ত্রর গলা শুকিয়ে গেল। লোকটা যেন রণপা লাগিয়ে তাকে ধাওয়া করেছে। সুমন্ত্র উপায়ান্তর না দেখে দৌড়তে শুরু করল। লোকটাও পিছু ছাড়ছে না। অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে গেছে লোকটা। যেন দৈত্য। সুমন্ত্র জীবনে কোনদিন এত জোরে দৌড়েছে বলে মনে পড়ল না। তার বাড়ি আর বেশি দূর নয়। আরেকটু, আরেকটু...... হঠাৎই মনে পড়ল রাম নাম জপ করলে নাকি ভুত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাই করতে করতে কোনরকমে নিজের বাড়ির দরজায় আছড়ে পড়ল। পাগলের মত দরজা ধাক্কাতে লাগল, "নীলিমা, নীলিমা! দরজা খোলো।" নীলিমা, তার স্ত্রী, দরজাটা খোলামাত্রই সে ঘরে ঢুকে সজোরে দরজাটায় খিল লাগিয়ে হাঁপাতে লাগল। নীলিমা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, "কি হয়েছে? এত হাঁপাচ্ছ কেন?" সুমন্ত্র বলল, "আগে একগ্লাস জল।" বলে সোফায় এলিয়ে পড়ল। নীলিমা জল নিয়ে এলে জলটা খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করল ও সমস্ত ঘটনাটা বলল। নীলিমা সব শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, "তুমি লোকটাকে প্রথমে ভবতোষদা ভেবেছিলে?" সুমন্ত্র বলল, "হ্যাঁ, কেন?" নীলিমা কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পরে উত্তর দিল, "ভবতোষদা তো আজ সকালে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।" চমকে উঠল সুমন্ত্র। তবে কি ওটা তার প্রেতাত্মা ছিল?

Monday 5 February 2018

ভুতুড়ে বাস।

কলেজ ছুটি হবার পরে বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে গল্প করতে করতে অনন্যার সময়ের আর খেয়ালই ছিল না। হঠাৎই ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর পড়ায় চমকে উঠল সে। এইরে, আজকে নির্ঘাত মার কাছে ঝাড় খেতে হবে। ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে দুএকবার ফোনও এসে গেছে। যথারীতি সে বলেছে, "বন্ধুর বাড়িতে আছি, চলে আসব, চিন্তা কোরো না।" কিন্তু এবারে তার টনক নড়ল। আর দেরি করলে বাস পাবে না। তার বাড়ি ফেরার একটাই বাস, না পেলে দুতিনবার ট্রেন পালটানো। সে অনেক ঝক্কি। তাড়াতাড়ি বান্ধবীকে টাটা করে দিয়ে বাসের জন্য রওনা হল অনন্যা। বাসে উঠে মাকে কি জবাবদিহি করবে, সেটাই ভাবতে লাগল।
অভাবের সংসার। বাবা তার ছোট থাকতেই গত হয়েছেন। মাই তাকে কষ্ট করে মানুষ করেছে। মার বড়ই বাধ্য মেয়ে সে। কিন্তু আজকে সে বড় অন্যায় করে ফেলেছে। আর কোনদিনও করবে না। আসলে কলেজে আজ ক্লাস শেষ হয়ে লম্বা ছুটি পড়ে গেল। সেই আনন্দে গল্প করতে করতে খেয়ালই নেই।

বাসটা চলছে বেশ দ্রুতবেগে। কিন্তু অনন্যার কেমন যেন একটা খটকা লাগল। বাসের ভিতরে যেন একটা আলো আধারি তৈরি হয়েছে আর সহযাত্রীরা তার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে দেখছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। কিন্তু জোর করে মনে সাহস সঞ্চয় করল। টেনশনে মানুষের অনেক সময় এরকম অনুভূতি হয়। শীতকালের কুয়াশার জন্য হয়ত এই আলো আধারি ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে। সে খুব একটা পাত্তা দিল না।

হঠাৎই তার নজরে পড়ল বাসটা বেশ খালি হয়ে এসেছে। একে তো রাত অনেক, তার ওপরে বাস প্রায় লাস্ট স্টপেজের কাছাকাছি এসে গেছে। লাস্ট স্টপেজের আগের স্টপে সে ছাড়া সবাই নেমে গেল। এখন বাসে শুধু সে, ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর। আচমকা বাসের সবগুলো আলো নিবে গেল। ব্যাপারটা অনন্যার কেমন লাগল। সে কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞাসা করল, "কি হল? বাসের সব আলো নিবিয়ে দিলেন কেন?" কন্ডাক্টর এর কোন উত্তর নেই। এমনকি সে মুখ ফিরিয়ে রইল। শীতের রাত বলে এমনিই লোকটা মাথায় একটা মাফলার জড়িয়ে রেখেছে, আর ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে আরোই তার মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। দুএকবার গায়ে ধাক্কা দিতে সে তার মুখটা অনন্যার দিকে ফেরাল। বিলীয়মান রাস্তার আবছা আলোতে তার মনে হল যেন একটা অন্তহীন গহ্বরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনন্যার সারা শরীরে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল। সে ড্রাইভারের কেবিনের দিকে দৌড়ে গিয়ে আকুলভাবে চিৎকার করতে লাগল, "ও দাদা, গাড়ি থামান, ও দাদা!" ড্রাইভারের কোন বিকার নেই। বাসের থামারও কোন লক্ষণ নেই। বেশ কয়েকবার কাকুতিমিনতি করবার পর ড্রাইভারও তার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল। চোখদুটোর গহ্বর যেন দুটি অগ্নিপিণ্ড। কি ভয়ংকর পৈশাচিক সেই দৃষ্টি! ছিটকে সরে এল অনন্যা। তবে কি মৃত্যু আসন্ন? না, এভাবে সে মরতে রাজি নয়। সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে যে দরজায় কন্ডাক্টর দাঁড়িয়ে ছিল না, সেই দরজা থেকে চোখ বুজে মারল এক লাফ। উফ, শরীরটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল তার। পাশ দিয়ে ভুতুড়ে বাসটা ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল। কোন দিকে গেল, কে জানে?
সকালবেলা অনন্যাদের পাড়ার শ্যামলবাবু বাজার করতে বেরিয়ে তার অজ্ঞান ও আহত দেহটা প্রথম দেখতে পান। শিগগিরিই তার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই অনন্যার মার বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করা এবং থানায় মিসিং ডায়রি করা হয়ে গেছে। যাই হোক, কথায় কথায় জানা গেল বহু বছর আগে সেখানে ঠিক ওই দিনে একটা বাস দুর্ঘটনা হয়েছিল যাতে ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর দুজনেই মারা যায়। দুজনেই নাকি মদ্যপ অবস্থায় ছিল। বাসে দ্বিতীয় লোক আর কেউ ছিল না।