Pages

Finance and Travel Ideas

Sunday 1 April 2018

বন্ধ দরজা।

পাখির ছবি তোলা রণবীরবাবুর অনেকদিনের শখ। যখনই সুযোগ পান বেরিয়ে পড়েন তার নিকন ডি ৭০০০ ক্যামেরাটা পিঠে ঝুলিয়ে। দুর্দান্ত এস এল আর ক্যামেরা, পাখির ছবি তোলার জন্য একেবারে আদর্শ। সঙ্গে ৮০-৪০০ লেন্সও রাখেন। তার তোলা ছবি বিভিন্ন নামকরা বন্যপ্রাণী বিষয়ক পত্রিকায় ছাপা ও প্রশংসিত হয়। এইবারে খবর পেলেন বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর চুপি চরে নানারকম বিদেশী পরিযায়ী পাখি আসে। অতএব পূর্বস্থলী যেতেই হচ্ছে। সকালবেলা বিধাননগর স্টেশন থেকে কাটোয়া লোকাল ধরলেন। পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়েই গেল। পৌঁছে স্টেশনের কাছেই একটা ছোটখাটো হোটেলে দুটো খেয়ে নিলেন। স্টেশন থেকে চুপি চর যাবার ভ্যান রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়, তারই একটা নিয়ে রওনা দিলেন। পথেই রিকশাওয়ালার মুখে জানতে পারলেন, পাখির ছবি তোলার একদম আদর্শ সময়ে (জানুয়ারি মাস) এসেছেন। চুপি চরে পৌঁছে দেখলেন পাখির ছবি তোলার উৎসাহী লোকজনের অভাব নেই। নৌকায় উঠে তিনিও ফটো তুলতে মগ্ন হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন ধরনের পাখি, তাদের বিভিন্ন রকমের আচার আচরণ, খুবই মনমুগ্ধকর। ফটো তুলতে তুলতে সময় যে কি ভাবে কেটে গেল, টেরই পেলেন না। হঠাৎই খেয়াল হল যে বিকেল হয়ে এসেছে, বাড়ি ফিরতে হবে। তড়িঘড়ি মাঝিকে বলে নৌকা পারে লাগিয়ে নেমে পড়লেন। শিয়ালদা কাটোয়া লোকাল অনেকক্ষণ বাদে বাদে ট্রেন, মিস করলে আজকে আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না। একটা ভ্যান রিকশা ভাড়া পেয়ে গেলেন, উঠেই বললেন, “স্টেশন, একটু তাড়াতাড়ি চলো ভাই।“ উত্তরে রিকশাওয়ালা বিড়বিড় করে কি বলল, বোঝা গেল না। মুখটা যেন একটু বেশি রকমই কাপড় দিয়ে ঢাকা।

রিকশা চলছে তো চলছেই, পথ যেন আর ফুরায় না। রণবীরবাবুর অবাক লাগল। চুপি চর থেকে পূর্বস্থলী স্টেশন অল্প কিছুক্ষণের পথ, এতো সময় কেন লাগবে? কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করলেন, “ও ভাই, স্টেশন এত সময় লাগছে কেন? রাস্তা ভুল করলে নাকি?” কোন উত্তর নেই। একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন, কিছুক্ষণ আগে ডানদিকে একটা মন্দির ছেড়ে এসেছিলেন, আবার সেই মন্দিরটা সামনে দেখা যাচ্ছে। একই রাস্তায় বারবার করে ঘুরছেন নাকি? ভয়ে শিউড়ে উঠলেন। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “ও ভাই, কি হল, রাস্তা ভুল করলে নাকি?” রিকশাওয়ালা নির্বাক। হঠাৎই একটা ঝটকা দিয়ে রিকশাটা দাঁড়িয়ে পড়ল। রণবীরবাবু বলে উঠলেন, “কি হল? হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে যে?” ভাঙা ভাঙা গলায় জবাব এল, “চেন পড়ে গেছে বাবু, রিকশা আর যাবে না।“ রণবীরবাবু দেখলেন মহা বিপদ। জিজ্ঞাসা করলেন, “এখান থেকে স্টেশন কিভাবে যাব?” রিকশাওয়ালা মুখে কিছু না বলে একটা মেঠো পথ দেখিয়ে দিল। অগত্যা কোন উপায় না দেখে সেই পথ ধরেই হাঁটতে শুরু করলেন। একটু গিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন রিকশাওয়ালা তাঁর রিকশা সমেত অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল তার। সামনে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অনেক দূরে দূরে একটা করে আলো, অল্প বাড়িঘর, কিন্তু বড্ড নির্জন। কিছুক্ষণ পরে একটা পোড়ো বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলেন। খুবই পুরনো বাড়ি, চারিদিকে কাঠের বেড়া দেওয়া। ঢুকেই আঁতকে উঠলেন। বাড়ির আশেপাশে বেশ কিছু মড়ার খুলি ও কাঠের পোড়া আসবাবপত্রের টুকরো ছড়ানো। তাড়াতাড়ি গেট খুলে বাইরে এসে আবার দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ গিয়ে আবার দেখলেন একটা পোড়ো বাড়ি। আরে, এই বাড়িটা তো আগের বাড়িটার মত হুবহু এক দেখতে। গেট খুলে সেই মড়ার খুলি ছড়ানো দেখে আবার দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসা, পথ চলতে থাকা। পরপর চার পাঁচবার রণবীরবাবুর একই অভিজ্ঞতা হল। সারা শরীর এই শীতকালে ঘামে ভিজে চপচপ করছে, পিঠে কামেরার ব্যাগটা মনে হচ্ছে যেন এক মণ ওজন। পাগুলো যেন অবশ হয়ে আসছে। আবার সেই পোড়ো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। বাড়িটা যেন তাকে চুম্বকের মত টানছে। মড়ার খুলিগুলো পেরিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটু ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। কিছুটা এগিয়ে আবার একটা দরজা। একটু ইতস্তত করলেন। মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, “খুলিস না, দরজাটা খুলিস না।“ দেখলেন দরজার তলা দিয়ে যেন পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তবুও দরজাটা খুলে ফেললেন। খুলে দেখলেন এক ভয়ংকর দৃশ্য। সারা ঘরে লেলিহান আগুনের শিখা এবং তার মধ্যে একটি যুবতী মেয়ে আগুন থেকে বাঁচবার জন্য আর্তনাদ করছে। কি মর্মান্তিক ও ভয়ংকর সে দৃশ্য! রণবীরবাবু যেন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লেন। আচমকা আগুনের শিখা রণবীরবাবুর দিকেও ধেয়ে এল। পালাতে গিয়েও পালাতে পারলেন না। যুবতী মেয়েটি যেন তাকে হাত ধরে টানতে লাগল। সারা শরীরে যেন উত্তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা লাগছে। আর্তস্বরে চিৎকারে ঘরটি যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। লেলিহান অগ্নিশিখা ক্রমশ দুজনকেই গ্রাস করল। মেঝে্তে পড়ে রইল শুধু একরাশ ছাই, দুটি মড়ার খুলি ও কিছু হাড়গোড়।
পুনশ্চঃ ওই বাড়িতে বহুবছর আগে আগুন লেগে বেশ কিছু লোকের প্রাণহানি হয়েছিল।