Pages

Finance and Travel Ideas

Sunday 27 May 2018

অভিশপ্ত ইঁদারা।

মনোজদের বাড়িটা বেশ পুরানো। প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি বাড়িটার বয়েস। বাড়িটার পিছন দিকে একটা ইঁদারা বা বাঁধানো পাতকুয়া আছে। কিন্তু বহু বছর আর ওটা কেউ ব্যবহার করেনা। বাড়িটার কিছু ইতিহাসও আছে বটে। এই বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন তার স্ত্রী সাংসারিক কারণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক ওই ইঁদারায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর ওই বাড়ির মালিক মনোজের ঠাকুরদাকে বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে চলে যান। কোথায় যান, তা আর জানা যায়নি বা কেউ জানার চেষ্টাও করেনি। ইঁদারার আশেপাশে এখন ঝোপঝাড় গজিয়ে গেছে। ওই দিকটা সবাই এড়িয়েই চলে। ওটা নাকি অশুভ। বহু বছর আগে মনোজের ঠাকুমা একবার জল তুলতে গিয়ে ভয়ংকর কিছু দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। তার পর থেকে যে ক বছর বেঁচে ছিলেন, সে সময় তার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা গেছিল। সব সময় বিড়বিড় করে কি বলতে থাকতেন, বোঝাই যেত না। 

মনোজ ছোটবেলা থেকেই বেশ সাহসী এবং যেকোনো অজানা ব্যাপারই তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। এখন সে কলেজে পড়ে। মাকে একদিন খেতে বসে ইঁদারাটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাও করেছিল কিন্তু মা তার দিকে এমনভাবে তাকাল যে সে আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ইঁদারাটার ব্যাপারে জানার কৌতূহল তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। একদিন সে এই ইঁদারার ব্যাপারটা ঠিক জানবে মনে মনে স্থির করল।


মনোজ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কবে বাড়িটা একটু ফাঁকা হবে। কিন্তু কিছুতেই সেই সুযোগ সে পাচ্ছিল না। বাড়িতে সব সময় লোক রয়েছে। অবশেষে সেই সুযোগ সে পেল। তাদের এক দুরসম্পর্কের আত্মীয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বাড়ির সব লোকই নিমন্ত্রিত। সে না যাবার একটা ছুতো খুঁজছিল। হঠাৎই মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে মাকে বলল পেটটা বড় ব্যথা করছে, অতএব সে যেতে চায় না। তাছাড়া সামনে পরীক্ষাও আছে, তার জন্য কিছু পড়ার কাজ বাকি আছে। মা অনুমতি দিল বাড়িতে থাকার। ব্যাস, আর কি চাই? কিন্তু বাড়ির লোকেরা রওনা দিতে দিতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে যাবে। সুতরাং সন্ধ্যের আগে কিছু করা যাবে না। বাড়ির লোকেরা সব বেরিয়ে যেতেই সদর দরজায় তালা দিয়ে সে হাতে একটা টর্চ আর লাঠি নিয়ে ইঁদারাটার দিকে এগোল। লাঠি নেবার কারণ সাপখোপ থাকতে পারে, যা ঝোপঝাড়! ইঁদারার কাছে এসে তার মনে হল মৃদু গলায় তাকে কেউ যেন ডাকল। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কেউ তো এসময় থাকার কথাও নয়। অগত্যা সে ইঁদারার দিকে মনোনিবেশ করল। নিচে জল আছে, কিন্তু ভিতরে বাইরে সব জায়গায় শ্যাওলা পড়ে গেছে। আকাশে হালকা চাঁদের আলো রয়েছে, তাও সে টর্চটা জ্বালল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এই কদিন আগেই টর্চে ব্যাটারি ভরা হয়েছে, বার কয়েক টিমটিম করে জ্বলেই নিভে গেল। মনোজের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। সে তবুও সাহস সঞ্চয় করল এবং ইঁদারার নিচের দিকে তাকাল। আবছা আলোয় মনে হল তার নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। কিন্তু প্রতিবিম্বটা যেন ক্রমশ বড় হচ্ছে আর উপর দিকেই উঠে আসছে। না, তার তো মাথায় এত বড় বড় চুল নেই আর মুখটাও এত ফ্যাকাসে নয়। এতো যেন কোন বয়স্ক মহিলার মুখ। অপলক দৃষ্টিতে মনোজের মুখের দিকে মুখটা তাকিয়ে রয়েছে। মুখের অভিব্যক্তি বর্ণনার বাইরে। মনোজের শরীরটা যেন শক্ত কাঠের মত হয়ে গেল, নড়াচড়া করার আর শক্তি নেই। হাত থেকে লাঠি আর টর্চ মাটিতে পড়ে গেল। হঠাৎ মহিলাটি তার দিকে হাত্টা বাড়াল। মনোজও মন্ত্রমুগ্ধের মত তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। কি হিমশীতল সেই স্পর্শ! তার দেহটাকে কেউ যেন পালকের মত তুলে নিয়েছে এবং ইঁদারার ভিতরে টেনে নিচ্ছে। তার মাথাটা নিচে আর পাগুলো ওপরে। ঠাণ্ডা জল তার শরীরটাকে স্পর্শ করল। সে ডুবছে, ক্রমশ ডুবছে। গলায় যেন ফাঁসের মত কি চেপে বসছে। তার সব অনুভূতি যেন তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ জলের উপরিভাগে একটু আলোড়ন, তারপর কয়েকটা শুধু বুদবুদ ভেসে উঠল। চারিদিক নিস্তব্ধ এখন।

পরের দিন সকালে বাড়ির লোকেরা দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে মনোজকে খুঁজে না পেয়ে তটস্থ। অবশেষে ইঁদারার পাশে পড়ে থাকা লাঠি আর টর্চ দেখে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল। রীতিমত দড়ি বেঁধে লোক নামিয়ে তার নির্জীব দেহটা তুলে আনা হল। সারা শরীরে যেন একফোঁটা রক্ত নেই, চোখগুলো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এল। পরে মনোজের বাবার নির্দেশে ইঁদারার মুখটা বন্ধ করে দেওয়া হল যাতে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা আর না ঘটে।