Pages

Finance and Travel Ideas

Tuesday 16 October 2018

কাজলদিঘির অপদেবতা।

গ্রামের নাম নিশ্চিন্দিপুর। খুবই সুন্দর একটি গ্রাম, পাহাড়ের কোলে সবুজিমা দিয়ে ঘেরা। গ্রামে চার পাঁচশ লোকের বাস। শান্তিতেই বসবাস করছিল সব, কোন ঝুটঝামেলা নেই। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে গ্রামে শুধু একটাই সমস্যা, আর সেইটা কাজলদিঘি সম্পর্কিত।

এই প্রসঙ্গে কাজলদিঘির ব্যাপারে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। এটি বহু বছর আগে খোঁড়া একটি মনুষ্যসৃষ্ট দিঘি। দিঘির আয়তন বিশাল, এপার থেকে ওপার হতে বেশ সময় লাগে। দিনের বেলা লোকে মাছ ধরে, সাঁতার কাটে, কোন ভয়ের ব্যাপার নেই। কিন্তু রাতের বেলা ওই পানে যাওয়া বারণ। কেন?

শোনা যায়, বহু বছর আগে গ্রামে এক বিধবা মহিলা বাস করত। তার নাম ছিল রেবা। সুতো কেটে, কাপড় সেলাই করে দিন গুজরান করত। খুবই অভাবের মধ্যে সংসার চলত। হঠাৎই একদিন রাতে সে নিখোঁজ হয়ে গেল। পরের দিন সকালে কাজলদিঘিতে তার দেহটা ভেসে ওঠে। শরীরটা জল খেয়ে ফুলে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে বিস্ফারিত। আত্মহত্যা না খুন, কিছুই জানা যায় না। কিছু দিন পর ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল।

এই ঘটনার পর থেকেই কাজলদিঘিতে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে থাকে এলাকার মানুষজনেরা। রাত্রিবেলা স্ত্রীলোকের গলায় কান্নার আওয়াজ অনেকেই নাকি শুনতে পায়। এলাকায় একবার ভুমিকম্প হয়। এলাকায় অন্যান্য যে দিঘিগুলি রয়েছে, সেগুলোর জলে কম্পন তো দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কাজলদিঘির জল যেন এপাশ ওপাশ হচ্ছে। এইরকম আলোড়ন খুব কমই দেখা যায়। অন্য দিঘিগুলোর জল স্থির হয়ে যাবার পরেও যেন কাজলদিঘির জল যেন থির থির করে কাঁপছিল। এলাকার লোকজন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই ঠিক করল যে পাশের গাঁয়ের রামেশ্বর গুণিনের শরণাপন্ন হবে।

রামেশ্বর গুণিন বাকসিদ্ধ এবং তন্ত্রসিদ্ধ গুণিন। চার পাঁচটা গ্রাম মিলিয়ে তার খুব নামডাক। ঝাড়ফুঁক, ভূত তাড়ানো, বাণ মারা, অপদেবতা থেকে মুক্তি, সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। অতএব তাকেই ডাকা হল। সবকিছু শুনে সে কিছুক্ষণ গাঁজায় দম দিয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর “বোম ভোলে! হর হর মহাদেব!” হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, “এখানে নৃমুণ্ডমালিনীর পূজা দিতে হবে। নইলে তোদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।“ সবাই রাজি হল। কিন্তু গুণিন এই সাবধান বাণীও দিল যে পর পর অন্তত তিন বছর এই পূজা চালিয়ে যেতে হবে। কোন বছর যদি পূজা বন্ধ থাকে, তাহলে বিপদ আবার ফিরে আসবে।

রামেশ্বর গুণিনের কথামত ষোড়শ উপচারে শ্মশান বিহারিণী দেবীর পূজার ব্যবস্থা হল। কিন্তু শবদেহের কি ব্যবস্থা হবে? ঠিক হল গ্রামের নিকটবর্তী শ্মশান থেকেই শবদেহ আনা হবে। পর পর দুবছর ঠিকঠাক পূজা সম্পন্ন হল। কিন্তু তৃতীয় বছরে একটা সমস্যা দেখা দিল। শ্মশান যে জমিতে ছিল, সেটা নাকি বিতর্কিত। জমির মালিক নাকি মামলায় জিতে জমির দখল নিয়ে কারখানা না কি করবে। অতএব কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী শ্মশান সরিয়ে নেওয়া হল। এবারে শবদেহ জোগাড় করাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোথাও শবদেহ পাওয়া গেল না। অভিসম্পাত করতে লাগল গুণিন। সেবছর পূজা আর হল না। তারপর একদিন রামেশ্বর গুণিনও ভোজবাজির মত গ্রাম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল, কেন গেল কেউ বলতে পারল না। তাকে সেই গ্রামে আর কেউ কোনদিন দেখতে পায়নি।

সবার মনেই শঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে এল। কাজলদিঘির আশেপাশে রাত্রিবেলা আবার শোনা যেতে লাগল নানারকম পৈশাচিক আর্তনাদ। সবাই জায়গাটা এড়িয়ে চলতে শুরু করল।

মনসুখ পাণ্ডে জন্মসূত্রে বিহারী, কিন্তু বহুবছর ধরে সে নিশ্চিন্দিপুরে বাস করছে। বাজারের কাছে তার একটা পানের দোকান আছে। প্রত্যেকদিনই সন্ধ্যে সন্ধ্যে সে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে, কিন্তু সেদিন একটু বিক্রিবাট্টা ভালো ছিল বলে যেন একটু বেশীই দেরি হয়ে গেল। যাই হোক, দোকানপাট বন্ধ করে সে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। বিক্রি ভালো হওয়াতে বেশ খোশ মেজাজ, একটা দেহাতি গান গুনগুন করতে করতে সে চলতে লাগল।     

মনসুখের বাড়ি ফেরার দুটো পথ আছে। একটা ঘুরপথ, বেশি সময় লাগে, কিন্তু ওই রাস্তায় কাজলদিঘি পড়ে না। আরেকটা কাজলদিঘির গা ঘেঁসেই, সেটা শর্টকাট হয়। মনসুখ ঠিক করল রাত হয়ে গেছে, শর্টকাট রাস্তাই ধরবে। জায়গাটার ইতিহাস তার খেয়ালই ছিল না। তাহলে হয়ত ওই রাস্তাটা সে বেছে নিত না।   



কাজলদিঘির ঠিক ধারেই একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনসুখের যেন মনে হল ফিসফিসিয়ে তার নাম ধরে কেউ ডাকল। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভাবল মনের ভুল। ভুল করে টর্চটাও দোকানে ফেলে এসেছে। পকেটে একটা দেশলাই বাক্স ছিল। বার করে দুএকটা কাঠি জ্বালাল। চারদিকে ভাল করে দেখল। নাহ, কেউ নেই। একটু এগিয়ে আবার সেই ডাক শুনল। এবার নজরটা শ্যাওড়া গাছের ওপর পড়ল। গাছের ওপরদিকের একটি ডালে যেন কেউ বসে আছে। আলো আধারিতে ভালো বুঝতে পারল না। মেয়েমানুষই মনে হল। কিন্তু এতরাতে গাছের ওপর সে কি করছে? একটু ভয়ও পেল, কৌতূহলও হল। দূর থেকেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনি? এত রাতে গাছের উপর কি করছেন?” মূর্তিটার কোন হেলদোল নেই। পা টিপে টিপে আরেকটু এগিয়ে গেল। এইবারে যা দেখল তাতে তার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল।

মনসুখ দেখল গাছের ডালে বসে তার দিকে চেয়ে রয়েছে একটি কঙ্কাল যার গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো। তার নরকরোটির দুটি চোখের গহ্বরে যেন আগুনের গোলা জ্বলজ্বল করছে। কঙ্কালটি যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। বীভৎস দন্তবিকশিত হাসিও যেন একঝলক দেখা গেল। ভয়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে মনসুখের ডান পাটা একটা গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তে যেন নরম কাদার মধ্যে তার পাটা ঢুকে যেতে লাগল। ভর দিয়ে পাটাকে বার করতে গিয়ে কেমনভাবে যেন অপর পাটাও গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তটা যেন একটা সুড়ঙ্গের মত, তার শরীরটাকে আস্তে আস্তে টেনে নিচ্ছে। গায়ে যেন জলের ঝাপটাও লাগছে। তাকে কি কেউ দিঘির নিচে টেনে নিচ্ছে? শরীরে যেন ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে মনসুখ। দম আটকে আসছে। তাকে কেউ যেন সাঁড়াশি দিয়ে পিষে ধরছে। শেষ মুহূর্তে কংকালের বিকট দংষ্ট্রাবিকশিত হাসি যেন দেখতে পেল মনসুখ। জলের উপরিভাগে কিছুক্ষণ আলোড়ন, হয়ত মনসুখেরই ছটপটানির ফলশ্রুতি, তারপর কিছু বুদবুদ ভেসে উঠল। তারপর দিঘির জল একদম স্থির।

পরের দিন সকালে গাঁয়ের মেয়েরা কাজলদিঘির পারে মনসুখের মৃতদেহটা আবিষ্কার করল। মনসুখ একাই থাকত, তাই রাতে তার জন্য কেউ খোঁজখবর করে নি। শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু কেউই কোন উপায় বাতলাতে পারল না এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার। গ্রাম পঞ্চায়েতের সভা ডাকা হল। আলাপ আলোচনার পর স্থির হল, আর কিছুদিন দেখা যাক। তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা আবার ঘটলে ওই দিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দিতে হবে। আপাতত রাত্রিবেলা ওই পথ কেউ যেন কোনভাবেই না মাড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হল।

কথায় আছে, ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না। সতর্ক করে দিলে কি হবে, ক্ষণিকের অসাবধানতায় বড় বিপদ ঘটে যেতেই পারে। গ্রামে চৌধুরীদের বাড়ির ছেলে সাগরেরও ঠিক তাই হল। সাগরের মায়ের এবং তার মাসির এই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। দুজনের শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। গ্রামে ডাক্তার বদ্যির খুব সমস্যা। সামান্য জ্বরজারি হলেই পাশের গাঁয়ে ছুটতে হয়। সাগরের মার একদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। সাগরের বাবা পড়ল মহা চিন্তায়। হঠাৎই তার মনে পড়ল সাগরের মাসির বর অল্প কবিরাজি বিদ্যা জানে, টুকটাক জ্বরজারির চিকিৎসাও করে থাকে। এত রাতে আর সাগরকে পাশের গাঁয়ে না পাঠিয়ে ওই বাড়িতে পাঠানোই সমীচীন হবে। সে সাগরকে ডেকে বলল, “বাবা সাগর, তোর মেসোমশাইয়ের কাছে এক ছুটে চলে যা। মার কথাটা বল। দেখ কিছু ওষুধ পথ্যির ব্যবস্থা দিতে পারে কিনা। আমি ততক্ষণ তোর মার জন্য জলপটির ব্যবস্থা করিগে।“ সাগর মা অন্ত প্রাণ, শুনেই মারল এক দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে খেয়ালই নেই সে কাজলদিঘির কাছে এসে পড়েছে। হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারিদিকে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

তার দিঘির ওপর চোখ গেল। অদ্ভুত একটা নীল নীল আলো খেলে বেড়াচ্ছে। আলেয়া? হবে হয়ত। আচমকা সে মহিলার গলায় এক তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেল। তার গা ছমছম করে উঠল। তাড়াতাড়ি এই জায়গাটা থেকে বেরোতে হবে। এই জায়গাটা অশুভ। কয়েকপা এগিয়েই দেখল সামনে একটা ডোবা। একি? এখানে তো আগে ডোবা ছিল না। অন্যদিকে যেতে গিয়ে আবার কয়েকপা ফেলে দেখে আরেকটা ডোবা। চারদিক যেন ডোবায় ভর্তি হয়ে গেছে। কি যে হচ্ছে, তার বোধগম্য হল না। পায়ে পায়ে কারা তার দিকে এগিয়ে আসছে? খনখনে গলায় কে যেন হেসে উঠল। সাগরের হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চারদিক থেকে নরকঙ্কালের দল তাকে ঘিরে ধরতে আসছে। তার মনের মধ্যে কে যেন আকুলিবিকুলি করে উঠল, “পালা, সাগর, পালা।“ কিন্তু পালাবে কোনদিকে? কঙ্কালের হাত থেকে বাঁচতে হলে তাকে দৌড়াতে হবে। কিন্তু যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই ডোবা। যা থাকে কপালে ভেবে মারল ঝাঁপ সামনের ডোবাটায়। জল একদম কনকনে ঠাণ্ডা। পায়ে যেন লতার মত কি জড়িয়ে যাচ্ছে। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, লতাগুলো যেন সাপের মত কিলবিল করে তার গলার দিকে এগিয়ে আসছে। পিচ্ছিল লতার স্পর্শ তাকে ভয়ার্ত করে তুলল। লতাগুলো তার গলায় চেপে বসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। শেষে এইভাবে তাকে মরতে হবে? তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল মায়ের অসুস্থ মুখের ছবিটা, যাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে এল। অতল জলের গহ্বরের আকর্ষণে যেন সে মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে সাগরের দেহটা দিঘি থেকে উদ্ধার হল। কোনভাবে সে দিঘিতে নেমেছিল আর পায়ে লতা জড়িয়ে যাওয়ায় আর উঠতে পারেনি। রাতেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সে যে এই পথে আসবে, কেউ ভাবেনি আর সাহসও করেনি। গ্রামবাসীরা আর কোন ঝুঁকি নিল না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজলদিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হল। এই দিঘির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি।

Saturday 6 October 2018

কুহকিনীর মায়া।

চলন্ত ডাউন বারুইপুর লোকালে বসে কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎই সামনের সিটের কোনার দিকে নজর পড়ল রজতের। একটি মেয়ে বসে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। এমনিতে রজতের চেহারাটা বেশ সুপুরুষ, রাস্তায় চলতে ফিরতে অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু এই ব্যাপারটা যেন একটু অন্যরকম। মেয়েটির চোখে যেন পলক পড়ছে না। চোখ সরিয়ে কিছুক্ষণ কাগজের দিকে মন দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখল একই ব্যাপার। স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি সালওয়ার কামিজ পরে রয়েছে, মাথায় ওড়নাটা হালকা ঢাকা দেওয়া আছে কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে। অপূর্ব সুন্দরী না হলেও একটা আকর্ষণ আছে। কিন্তু চাউনিটা যেন কেমন। গা ছম ছম করে উঠল তার। এরকম অভিজ্ঞতা তার কোনদিনই হয়নি। জোর করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। তার স্টেশন আসাতে নেমেও গেল। একটু অন্যমনস্ক ছিল, অনেক ভিড়ের মধ্যে সেই মেয়েটিও নামল কিনা খেয়াল করতে পারল না। মন থেকে ব্যাপারটাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করল।

কিন্তু পরের দিনও রজতের একই অভিজ্ঞতা হল। মেয়েটি ঠিক তার সামনের সিটে বসে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। ব্যাপারটা কি? মেয়েটি কি তাকে চেনে? তাকে কি কিছু বলতে চায়? ডেকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারে, এমন অস্বস্তিকর ভাবে চেয়ে থাকার মানেটা কি? রজতের মনের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। 

পর পর বেশ কয়েকদিন তার এই অভিজ্ঞতা হয়। অফিসে, বাড়িতে, কাজে, কর্মে সব জায়গায় রজত যেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। এমনিতে সে খুব মিশুকে নয়, কিন্তু অফিসে অনিলই এমন একজন যার সঙ্গে সে নিজের সুখ দুঃখের কথা একটু আধটু ভাগ করে নেয়। একদিন সে বলেই ফেলল কথাটা। 

“জানিস অনিল, প্রত্যেকদিন অফিস থেকে ফেরার ট্রেনে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।“
“সে কি রে? কিরকম শুনি?”
“একটা মেয়ে সামনের সিটে বসে আমার দিকে রোজ তাকিয়ে থাকে।“
“তাই নাকি? তা এতে অদ্ভুত কি আছে? তুই এত সুপুরুষ, হয়ত তোকে ভালো লেগেছে।“
“ব্যাপারটা এতো মজার নয় রে। মেয়েটার চাউনি যেন কেমন। আমার অস্বস্তি লাগে।“
“কেন? কি রকম চাউনি?”
“সে তোকে বলে বোঝানো যাবে না।”
রজত চুপ করে যায়। অনিলও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি আর ঘাঁটায় না, নিজের কাজে মন দেয়।

আরও দুচার দিন এই ভাবে চলে। একদিন ট্রেনটা যেন একটু বেশিই ফাঁকা ছিল। মেয়েটি একদম তার সামনে এসে বসে পড়ল। রজত একটু চমকে উঠল। কিন্তু মনে মনে সে স্থির করল যে আজ সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবেই। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের জড়তাটা কাটিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “শুনুন, কিছু যদি মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”
“হ্যাঁ, বলুন।“
“আপনি কি আমাকে কোনভাবে চেনেন? বা আগে কোথাও দেখেছেন?”
“কই, না তো।“
“তাহলে আপনি......আমার দিকে দেখি রোজই তাকিয়ে থাকেন?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।“
রজত চমকে উঠল। কি বলবে বুঝতে পারল না। একি মেয়েরে বাবা! সেদিন আর কথা এগোল না।


এরপর কয়েকদিন ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে আরও কিছু কথা হল মেয়েটির সঙ্গে। আস্তে আস্তে রজতও সহজভাবে কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে লাগল। ধীরে ধীরে তার অস্বস্তি কাটতে লাগল। যদিও সে কখনো প্রশ্ন করেনি তাকে কেন মেয়েটির খুব ভালো লাগে।

কথায় কথায় অনেককিছুই সে জানতে পারল মেয়েটির সম্বন্ধে। তার নাম মোহিনী, সে একটি সওদাগরী অফিসে রিসেপশনিস্টের কাজ করে। বাবা মা সে ছোট থাকতেই মারা গেছেন, মামাবাড়িতেই মানুষ। বারুইপুরে সে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে কারণ মামাবাড়িতে থাকার জায়গার খুব সমস্যা। মোহিনীও রজতের সম্পর্কে সবই জেনে নিয়েছে। বাবা মার একমাত্র ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা, উজ্জল ভবিষ্যৎ। কোম্পানিতে তার পদোন্নতি চোখে পড়ার মত। তরতরিয়ে উপরে উঠছে। কিছুদিনের মধ্যে রজতেরও মোহিনীকে ভালো লাগতে শুরু করল। 

এইরকম ভাবে চলছে। একদিন হঠাৎ মোহিনীই প্রস্তাবটা দিল, “চল না, একদিন ভিক্টোরিয়া, ময়দান এসব জায়গা ঘুরে আসি।“ রজত দেখল প্রস্তাব মন্দ নয়। প্রেম করার পক্ষে বেশ ভালো জায়গা এগুলো। এক রবিবার ঠিক হল যাওয়া। সময়টা বেশ কাটল দুজনের। ফেরার পথে একটা বেশ নামকরা রেস্তরাঁতে খেয়েও নিল দুজনে। কিন্তু যখন ট্যাক্সি করে ফিরছে সন্ধেবেলা, তখনই রজতের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

সেদিন মনে হয় পূর্ণিমা ছিল, আকাশে চাঁদটা থালার মত ঝলমল করছিল। ট্যাক্সিতে বসে রজত অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে মোহিনীর কোন ছায়া পড়ছে না। আর চাউনিটাও যেন কেমন অস্বাভাবিক। বাড়ি ফিরে সে এই ঘটনাটা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ল। তবে কাউকে কিছু জানাল না।

অনেকদিন ধরেই মোহিনী বায়না করছিল যে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কোথাও আউটিংএ যাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সেদিনের সেই ট্যাক্সির ঘটনা ঘটার পর রজতের খুব একটা উৎসাহ নেই। এদিকে মোহিনীরও প্রচণ্ড জেদ, যেতেই হবে। অগত্যা রজত রাজি হয়েই গেল। যদিও মনের ভিতরটা খচখচ করতেই লাগল।

দুজনে মিলে মন্দারমণিই ঠিক করল। বেশ নিরিবিলি জায়গা, বেড়ানোর পক্ষে বেশ ভালো। মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনেই রওনা দিল। ট্রেনে মন্দারমণি যেতে গেলে কাঁথিতে নামতে হয়, সেখান থেকে আবার গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বেশ ভালো একটা হোটেলে বুকিং করাই ছিল, সি ফেসিং একটা ঘর পাওয়া গেল। দিনের বেলা বেশ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে কেটে গেল সময়টা। কিন্তু রাত্রিবেলা যে ঘটনাটা ঘটল সেটা যেকোনো মানুষের মনকে বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুজনেই হোটেলে বেডরুমে এসে শুয়েছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রত্যেকদিনই রজতের বই পড়া অভ্যেস। এদিন সে ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” পড়ছিল। হঠাৎই মোহিনী তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস কর?”
“নাহ, তবে পড়তে ভালো লাগে এই আর কি।“
“ওঃ।“
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার প্রশ্ন করল, “যদি তুমি সামনাসামনি ভ্যাম্পায়ার দেখো, তোমার কেমন লাগবে?”
রজত চমকে উঠল। এই রকম প্রশ্ন সে আশা করেনি। মোহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখল কেমন যেন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরের বাইরেও আবহাওয়াটাও যেন পরিবর্তিত হচ্ছে। ঠাণ্ডা একটা হিমেল হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। মোহিনী হঠাৎই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে “যত্তসব বাজে কথা” বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল রজত। বইটা রেখে আলোটা নিভিয়ে দিল। আজ আর তার কিছু ভালো লাগছেনা।

কিন্তু মাঝরাতে যখন মোহিনী তাকে কাছে টেনে নিল, তার মধ্যে কামনার প্রবৃত্তি জেগে উঠল। সবই ঠিকঠাক ছিল, শুধু মোহিনীর শরীরটা তার যেন অসম্ভব শীতল মনে হল। এই প্রথম তাদের দৈহিক সম্পর্ক, কিন্তু রজত যেন সম্পূর্ণভাবে তা উপভোগ করতে পারল না। নিজেকে তার যেন একটা যন্ত্র বলে মনে হল।

মিলন শেষে রজত এলিয়ে পড়েছিল। শরীরটা যেন নিস্তেজ। হঠাৎই দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজাটা খুলে গেল। চমকে উঠে পাশ ফিরতেই দেখল মোহিনী পাশে নেই। গেল কোথায়? হঠাৎই বারান্দার দিকে নজর গেল। বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে? মোহিনী না? কিন্ত এ কোন মোহিনী? তার দেহটা যেন স্বচ্ছ, তার মধ্যে দিয়ে দুরের আকাশ, চিকচিকে তারা দেখা যাচ্ছে। মোহিনী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। কিন্তু রজত কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিন্তু মন্ত্রের মত যেন তাকে মোহিনী টানছে। সে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোহিনী তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু এই জড়ানো যেন প্রেমিকার আলিঙ্গন নয়। এ যেন অজগরের আলিঙ্গন। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সে চিৎকার করতে গেল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না। তার গোটা শরীরটা যেন বরফ জলে ডুবে যাচ্ছে। মোহিনীর লিপস্টিকে রাঙা সুন্দর দুটি ঠোঁটের পাশ দিয়ে ভয়াল একজোড়া ছুঁচলো দাঁত বেরিয়ে আসছে কেন? এরকম কি কোন স্বাভাবিক মানুষের হয়? এক ঝাঁকুনি দিয়ে রজতের গলাটা তার দিকে টেনে নিয়ে মোহিনী দাঁত বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তা দিয়ে মোহিনী যেন কতদিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। রজতের শরীরটা যেন খাঁচায় পোরা পাখির মত ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। তাকে পালকের মত তুলে নিয়ে হোটেলের তিনতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মোহিনী। সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজেই হয়ত নিচে পড়ার আওয়াজটা চাপা পড়ে গেল। জিঘাংসা ভরা দৃষ্টিতে নিচে একবার তাকিয়েই মোহিনী ধোঁয়ার মত বাতাসে মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে হোটেলের এক কর্মচারী রজতের মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। চোখদুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। শরীরটা যেন রক্তশূন্য কাঠের মত পড়ে রয়েছে। কেউ যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। গলার বাঁদিকে দুটো গোল সমান্তরাল ক্ষতচিহ্ন। আস্তে আস্তে তার চারপাশের ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। পুলিশকে খবর দিতে হবে।