Pages

Finance and Travel Ideas

Tuesday 16 October 2018

কাজলদিঘির অপদেবতা।

গ্রামের নাম নিশ্চিন্দিপুর। খুবই সুন্দর একটি গ্রাম, পাহাড়ের কোলে সবুজিমা দিয়ে ঘেরা। গ্রামে চার পাঁচশ লোকের বাস। শান্তিতেই বসবাস করছিল সব, কোন ঝুটঝামেলা নেই। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে গ্রামে শুধু একটাই সমস্যা, আর সেইটা কাজলদিঘি সম্পর্কিত।

এই প্রসঙ্গে কাজলদিঘির ব্যাপারে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। এটি বহু বছর আগে খোঁড়া একটি মনুষ্যসৃষ্ট দিঘি। দিঘির আয়তন বিশাল, এপার থেকে ওপার হতে বেশ সময় লাগে। দিনের বেলা লোকে মাছ ধরে, সাঁতার কাটে, কোন ভয়ের ব্যাপার নেই। কিন্তু রাতের বেলা ওই পানে যাওয়া বারণ। কেন?

শোনা যায়, বহু বছর আগে গ্রামে এক বিধবা মহিলা বাস করত। তার নাম ছিল রেবা। সুতো কেটে, কাপড় সেলাই করে দিন গুজরান করত। খুবই অভাবের মধ্যে সংসার চলত। হঠাৎই একদিন রাতে সে নিখোঁজ হয়ে গেল। পরের দিন সকালে কাজলদিঘিতে তার দেহটা ভেসে ওঠে। শরীরটা জল খেয়ে ফুলে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে বিস্ফারিত। আত্মহত্যা না খুন, কিছুই জানা যায় না। কিছু দিন পর ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল।

এই ঘটনার পর থেকেই কাজলদিঘিতে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে থাকে এলাকার মানুষজনেরা। রাত্রিবেলা স্ত্রীলোকের গলায় কান্নার আওয়াজ অনেকেই নাকি শুনতে পায়। এলাকায় একবার ভুমিকম্প হয়। এলাকায় অন্যান্য যে দিঘিগুলি রয়েছে, সেগুলোর জলে কম্পন তো দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কাজলদিঘির জল যেন এপাশ ওপাশ হচ্ছে। এইরকম আলোড়ন খুব কমই দেখা যায়। অন্য দিঘিগুলোর জল স্থির হয়ে যাবার পরেও যেন কাজলদিঘির জল যেন থির থির করে কাঁপছিল। এলাকার লোকজন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই ঠিক করল যে পাশের গাঁয়ের রামেশ্বর গুণিনের শরণাপন্ন হবে।

রামেশ্বর গুণিন বাকসিদ্ধ এবং তন্ত্রসিদ্ধ গুণিন। চার পাঁচটা গ্রাম মিলিয়ে তার খুব নামডাক। ঝাড়ফুঁক, ভূত তাড়ানো, বাণ মারা, অপদেবতা থেকে মুক্তি, সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। অতএব তাকেই ডাকা হল। সবকিছু শুনে সে কিছুক্ষণ গাঁজায় দম দিয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর “বোম ভোলে! হর হর মহাদেব!” হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, “এখানে নৃমুণ্ডমালিনীর পূজা দিতে হবে। নইলে তোদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।“ সবাই রাজি হল। কিন্তু গুণিন এই সাবধান বাণীও দিল যে পর পর অন্তত তিন বছর এই পূজা চালিয়ে যেতে হবে। কোন বছর যদি পূজা বন্ধ থাকে, তাহলে বিপদ আবার ফিরে আসবে।

রামেশ্বর গুণিনের কথামত ষোড়শ উপচারে শ্মশান বিহারিণী দেবীর পূজার ব্যবস্থা হল। কিন্তু শবদেহের কি ব্যবস্থা হবে? ঠিক হল গ্রামের নিকটবর্তী শ্মশান থেকেই শবদেহ আনা হবে। পর পর দুবছর ঠিকঠাক পূজা সম্পন্ন হল। কিন্তু তৃতীয় বছরে একটা সমস্যা দেখা দিল। শ্মশান যে জমিতে ছিল, সেটা নাকি বিতর্কিত। জমির মালিক নাকি মামলায় জিতে জমির দখল নিয়ে কারখানা না কি করবে। অতএব কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী শ্মশান সরিয়ে নেওয়া হল। এবারে শবদেহ জোগাড় করাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোথাও শবদেহ পাওয়া গেল না। অভিসম্পাত করতে লাগল গুণিন। সেবছর পূজা আর হল না। তারপর একদিন রামেশ্বর গুণিনও ভোজবাজির মত গ্রাম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল, কেন গেল কেউ বলতে পারল না। তাকে সেই গ্রামে আর কেউ কোনদিন দেখতে পায়নি।

সবার মনেই শঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে এল। কাজলদিঘির আশেপাশে রাত্রিবেলা আবার শোনা যেতে লাগল নানারকম পৈশাচিক আর্তনাদ। সবাই জায়গাটা এড়িয়ে চলতে শুরু করল।

মনসুখ পাণ্ডে জন্মসূত্রে বিহারী, কিন্তু বহুবছর ধরে সে নিশ্চিন্দিপুরে বাস করছে। বাজারের কাছে তার একটা পানের দোকান আছে। প্রত্যেকদিনই সন্ধ্যে সন্ধ্যে সে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে, কিন্তু সেদিন একটু বিক্রিবাট্টা ভালো ছিল বলে যেন একটু বেশীই দেরি হয়ে গেল। যাই হোক, দোকানপাট বন্ধ করে সে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। বিক্রি ভালো হওয়াতে বেশ খোশ মেজাজ, একটা দেহাতি গান গুনগুন করতে করতে সে চলতে লাগল।     

মনসুখের বাড়ি ফেরার দুটো পথ আছে। একটা ঘুরপথ, বেশি সময় লাগে, কিন্তু ওই রাস্তায় কাজলদিঘি পড়ে না। আরেকটা কাজলদিঘির গা ঘেঁসেই, সেটা শর্টকাট হয়। মনসুখ ঠিক করল রাত হয়ে গেছে, শর্টকাট রাস্তাই ধরবে। জায়গাটার ইতিহাস তার খেয়ালই ছিল না। তাহলে হয়ত ওই রাস্তাটা সে বেছে নিত না।   



কাজলদিঘির ঠিক ধারেই একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনসুখের যেন মনে হল ফিসফিসিয়ে তার নাম ধরে কেউ ডাকল। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভাবল মনের ভুল। ভুল করে টর্চটাও দোকানে ফেলে এসেছে। পকেটে একটা দেশলাই বাক্স ছিল। বার করে দুএকটা কাঠি জ্বালাল। চারদিকে ভাল করে দেখল। নাহ, কেউ নেই। একটু এগিয়ে আবার সেই ডাক শুনল। এবার নজরটা শ্যাওড়া গাছের ওপর পড়ল। গাছের ওপরদিকের একটি ডালে যেন কেউ বসে আছে। আলো আধারিতে ভালো বুঝতে পারল না। মেয়েমানুষই মনে হল। কিন্তু এতরাতে গাছের ওপর সে কি করছে? একটু ভয়ও পেল, কৌতূহলও হল। দূর থেকেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনি? এত রাতে গাছের উপর কি করছেন?” মূর্তিটার কোন হেলদোল নেই। পা টিপে টিপে আরেকটু এগিয়ে গেল। এইবারে যা দেখল তাতে তার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল।

মনসুখ দেখল গাছের ডালে বসে তার দিকে চেয়ে রয়েছে একটি কঙ্কাল যার গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো। তার নরকরোটির দুটি চোখের গহ্বরে যেন আগুনের গোলা জ্বলজ্বল করছে। কঙ্কালটি যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। বীভৎস দন্তবিকশিত হাসিও যেন একঝলক দেখা গেল। ভয়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে মনসুখের ডান পাটা একটা গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তে যেন নরম কাদার মধ্যে তার পাটা ঢুকে যেতে লাগল। ভর দিয়ে পাটাকে বার করতে গিয়ে কেমনভাবে যেন অপর পাটাও গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তটা যেন একটা সুড়ঙ্গের মত, তার শরীরটাকে আস্তে আস্তে টেনে নিচ্ছে। গায়ে যেন জলের ঝাপটাও লাগছে। তাকে কি কেউ দিঘির নিচে টেনে নিচ্ছে? শরীরে যেন ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে মনসুখ। দম আটকে আসছে। তাকে কেউ যেন সাঁড়াশি দিয়ে পিষে ধরছে। শেষ মুহূর্তে কংকালের বিকট দংষ্ট্রাবিকশিত হাসি যেন দেখতে পেল মনসুখ। জলের উপরিভাগে কিছুক্ষণ আলোড়ন, হয়ত মনসুখেরই ছটপটানির ফলশ্রুতি, তারপর কিছু বুদবুদ ভেসে উঠল। তারপর দিঘির জল একদম স্থির।

পরের দিন সকালে গাঁয়ের মেয়েরা কাজলদিঘির পারে মনসুখের মৃতদেহটা আবিষ্কার করল। মনসুখ একাই থাকত, তাই রাতে তার জন্য কেউ খোঁজখবর করে নি। শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু কেউই কোন উপায় বাতলাতে পারল না এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার। গ্রাম পঞ্চায়েতের সভা ডাকা হল। আলাপ আলোচনার পর স্থির হল, আর কিছুদিন দেখা যাক। তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা আবার ঘটলে ওই দিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দিতে হবে। আপাতত রাত্রিবেলা ওই পথ কেউ যেন কোনভাবেই না মাড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হল।

কথায় আছে, ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না। সতর্ক করে দিলে কি হবে, ক্ষণিকের অসাবধানতায় বড় বিপদ ঘটে যেতেই পারে। গ্রামে চৌধুরীদের বাড়ির ছেলে সাগরেরও ঠিক তাই হল। সাগরের মায়ের এবং তার মাসির এই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। দুজনের শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। গ্রামে ডাক্তার বদ্যির খুব সমস্যা। সামান্য জ্বরজারি হলেই পাশের গাঁয়ে ছুটতে হয়। সাগরের মার একদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। সাগরের বাবা পড়ল মহা চিন্তায়। হঠাৎই তার মনে পড়ল সাগরের মাসির বর অল্প কবিরাজি বিদ্যা জানে, টুকটাক জ্বরজারির চিকিৎসাও করে থাকে। এত রাতে আর সাগরকে পাশের গাঁয়ে না পাঠিয়ে ওই বাড়িতে পাঠানোই সমীচীন হবে। সে সাগরকে ডেকে বলল, “বাবা সাগর, তোর মেসোমশাইয়ের কাছে এক ছুটে চলে যা। মার কথাটা বল। দেখ কিছু ওষুধ পথ্যির ব্যবস্থা দিতে পারে কিনা। আমি ততক্ষণ তোর মার জন্য জলপটির ব্যবস্থা করিগে।“ সাগর মা অন্ত প্রাণ, শুনেই মারল এক দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে খেয়ালই নেই সে কাজলদিঘির কাছে এসে পড়েছে। হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারিদিকে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

তার দিঘির ওপর চোখ গেল। অদ্ভুত একটা নীল নীল আলো খেলে বেড়াচ্ছে। আলেয়া? হবে হয়ত। আচমকা সে মহিলার গলায় এক তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেল। তার গা ছমছম করে উঠল। তাড়াতাড়ি এই জায়গাটা থেকে বেরোতে হবে। এই জায়গাটা অশুভ। কয়েকপা এগিয়েই দেখল সামনে একটা ডোবা। একি? এখানে তো আগে ডোবা ছিল না। অন্যদিকে যেতে গিয়ে আবার কয়েকপা ফেলে দেখে আরেকটা ডোবা। চারদিক যেন ডোবায় ভর্তি হয়ে গেছে। কি যে হচ্ছে, তার বোধগম্য হল না। পায়ে পায়ে কারা তার দিকে এগিয়ে আসছে? খনখনে গলায় কে যেন হেসে উঠল। সাগরের হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চারদিক থেকে নরকঙ্কালের দল তাকে ঘিরে ধরতে আসছে। তার মনের মধ্যে কে যেন আকুলিবিকুলি করে উঠল, “পালা, সাগর, পালা।“ কিন্তু পালাবে কোনদিকে? কঙ্কালের হাত থেকে বাঁচতে হলে তাকে দৌড়াতে হবে। কিন্তু যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই ডোবা। যা থাকে কপালে ভেবে মারল ঝাঁপ সামনের ডোবাটায়। জল একদম কনকনে ঠাণ্ডা। পায়ে যেন লতার মত কি জড়িয়ে যাচ্ছে। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, লতাগুলো যেন সাপের মত কিলবিল করে তার গলার দিকে এগিয়ে আসছে। পিচ্ছিল লতার স্পর্শ তাকে ভয়ার্ত করে তুলল। লতাগুলো তার গলায় চেপে বসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। শেষে এইভাবে তাকে মরতে হবে? তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল মায়ের অসুস্থ মুখের ছবিটা, যাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে এল। অতল জলের গহ্বরের আকর্ষণে যেন সে মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে সাগরের দেহটা দিঘি থেকে উদ্ধার হল। কোনভাবে সে দিঘিতে নেমেছিল আর পায়ে লতা জড়িয়ে যাওয়ায় আর উঠতে পারেনি। রাতেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সে যে এই পথে আসবে, কেউ ভাবেনি আর সাহসও করেনি। গ্রামবাসীরা আর কোন ঝুঁকি নিল না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজলদিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হল। এই দিঘির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি।

No comments:

Post a Comment