Pages

Finance and Travel Ideas

Saturday 6 October 2018

কুহকিনীর মায়া।

চলন্ত ডাউন বারুইপুর লোকালে বসে কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎই সামনের সিটের কোনার দিকে নজর পড়ল রজতের। একটি মেয়ে বসে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। এমনিতে রজতের চেহারাটা বেশ সুপুরুষ, রাস্তায় চলতে ফিরতে অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু এই ব্যাপারটা যেন একটু অন্যরকম। মেয়েটির চোখে যেন পলক পড়ছে না। চোখ সরিয়ে কিছুক্ষণ কাগজের দিকে মন দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখল একই ব্যাপার। স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি সালওয়ার কামিজ পরে রয়েছে, মাথায় ওড়নাটা হালকা ঢাকা দেওয়া আছে কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে। অপূর্ব সুন্দরী না হলেও একটা আকর্ষণ আছে। কিন্তু চাউনিটা যেন কেমন। গা ছম ছম করে উঠল তার। এরকম অভিজ্ঞতা তার কোনদিনই হয়নি। জোর করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। তার স্টেশন আসাতে নেমেও গেল। একটু অন্যমনস্ক ছিল, অনেক ভিড়ের মধ্যে সেই মেয়েটিও নামল কিনা খেয়াল করতে পারল না। মন থেকে ব্যাপারটাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করল।

কিন্তু পরের দিনও রজতের একই অভিজ্ঞতা হল। মেয়েটি ঠিক তার সামনের সিটে বসে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। ব্যাপারটা কি? মেয়েটি কি তাকে চেনে? তাকে কি কিছু বলতে চায়? ডেকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারে, এমন অস্বস্তিকর ভাবে চেয়ে থাকার মানেটা কি? রজতের মনের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। 

পর পর বেশ কয়েকদিন তার এই অভিজ্ঞতা হয়। অফিসে, বাড়িতে, কাজে, কর্মে সব জায়গায় রজত যেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। এমনিতে সে খুব মিশুকে নয়, কিন্তু অফিসে অনিলই এমন একজন যার সঙ্গে সে নিজের সুখ দুঃখের কথা একটু আধটু ভাগ করে নেয়। একদিন সে বলেই ফেলল কথাটা। 

“জানিস অনিল, প্রত্যেকদিন অফিস থেকে ফেরার ট্রেনে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।“
“সে কি রে? কিরকম শুনি?”
“একটা মেয়ে সামনের সিটে বসে আমার দিকে রোজ তাকিয়ে থাকে।“
“তাই নাকি? তা এতে অদ্ভুত কি আছে? তুই এত সুপুরুষ, হয়ত তোকে ভালো লেগেছে।“
“ব্যাপারটা এতো মজার নয় রে। মেয়েটার চাউনি যেন কেমন। আমার অস্বস্তি লাগে।“
“কেন? কি রকম চাউনি?”
“সে তোকে বলে বোঝানো যাবে না।”
রজত চুপ করে যায়। অনিলও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি আর ঘাঁটায় না, নিজের কাজে মন দেয়।

আরও দুচার দিন এই ভাবে চলে। একদিন ট্রেনটা যেন একটু বেশিই ফাঁকা ছিল। মেয়েটি একদম তার সামনে এসে বসে পড়ল। রজত একটু চমকে উঠল। কিন্তু মনে মনে সে স্থির করল যে আজ সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবেই। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের জড়তাটা কাটিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “শুনুন, কিছু যদি মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”
“হ্যাঁ, বলুন।“
“আপনি কি আমাকে কোনভাবে চেনেন? বা আগে কোথাও দেখেছেন?”
“কই, না তো।“
“তাহলে আপনি......আমার দিকে দেখি রোজই তাকিয়ে থাকেন?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।“
রজত চমকে উঠল। কি বলবে বুঝতে পারল না। একি মেয়েরে বাবা! সেদিন আর কথা এগোল না।


এরপর কয়েকদিন ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে আরও কিছু কথা হল মেয়েটির সঙ্গে। আস্তে আস্তে রজতও সহজভাবে কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে লাগল। ধীরে ধীরে তার অস্বস্তি কাটতে লাগল। যদিও সে কখনো প্রশ্ন করেনি তাকে কেন মেয়েটির খুব ভালো লাগে।

কথায় কথায় অনেককিছুই সে জানতে পারল মেয়েটির সম্বন্ধে। তার নাম মোহিনী, সে একটি সওদাগরী অফিসে রিসেপশনিস্টের কাজ করে। বাবা মা সে ছোট থাকতেই মারা গেছেন, মামাবাড়িতেই মানুষ। বারুইপুরে সে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে কারণ মামাবাড়িতে থাকার জায়গার খুব সমস্যা। মোহিনীও রজতের সম্পর্কে সবই জেনে নিয়েছে। বাবা মার একমাত্র ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা, উজ্জল ভবিষ্যৎ। কোম্পানিতে তার পদোন্নতি চোখে পড়ার মত। তরতরিয়ে উপরে উঠছে। কিছুদিনের মধ্যে রজতেরও মোহিনীকে ভালো লাগতে শুরু করল। 

এইরকম ভাবে চলছে। একদিন হঠাৎ মোহিনীই প্রস্তাবটা দিল, “চল না, একদিন ভিক্টোরিয়া, ময়দান এসব জায়গা ঘুরে আসি।“ রজত দেখল প্রস্তাব মন্দ নয়। প্রেম করার পক্ষে বেশ ভালো জায়গা এগুলো। এক রবিবার ঠিক হল যাওয়া। সময়টা বেশ কাটল দুজনের। ফেরার পথে একটা বেশ নামকরা রেস্তরাঁতে খেয়েও নিল দুজনে। কিন্তু যখন ট্যাক্সি করে ফিরছে সন্ধেবেলা, তখনই রজতের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

সেদিন মনে হয় পূর্ণিমা ছিল, আকাশে চাঁদটা থালার মত ঝলমল করছিল। ট্যাক্সিতে বসে রজত অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে মোহিনীর কোন ছায়া পড়ছে না। আর চাউনিটাও যেন কেমন অস্বাভাবিক। বাড়ি ফিরে সে এই ঘটনাটা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ল। তবে কাউকে কিছু জানাল না।

অনেকদিন ধরেই মোহিনী বায়না করছিল যে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কোথাও আউটিংএ যাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সেদিনের সেই ট্যাক্সির ঘটনা ঘটার পর রজতের খুব একটা উৎসাহ নেই। এদিকে মোহিনীরও প্রচণ্ড জেদ, যেতেই হবে। অগত্যা রজত রাজি হয়েই গেল। যদিও মনের ভিতরটা খচখচ করতেই লাগল।

দুজনে মিলে মন্দারমণিই ঠিক করল। বেশ নিরিবিলি জায়গা, বেড়ানোর পক্ষে বেশ ভালো। মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনেই রওনা দিল। ট্রেনে মন্দারমণি যেতে গেলে কাঁথিতে নামতে হয়, সেখান থেকে আবার গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বেশ ভালো একটা হোটেলে বুকিং করাই ছিল, সি ফেসিং একটা ঘর পাওয়া গেল। দিনের বেলা বেশ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে কেটে গেল সময়টা। কিন্তু রাত্রিবেলা যে ঘটনাটা ঘটল সেটা যেকোনো মানুষের মনকে বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুজনেই হোটেলে বেডরুমে এসে শুয়েছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রত্যেকদিনই রজতের বই পড়া অভ্যেস। এদিন সে ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” পড়ছিল। হঠাৎই মোহিনী তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস কর?”
“নাহ, তবে পড়তে ভালো লাগে এই আর কি।“
“ওঃ।“
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার প্রশ্ন করল, “যদি তুমি সামনাসামনি ভ্যাম্পায়ার দেখো, তোমার কেমন লাগবে?”
রজত চমকে উঠল। এই রকম প্রশ্ন সে আশা করেনি। মোহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখল কেমন যেন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরের বাইরেও আবহাওয়াটাও যেন পরিবর্তিত হচ্ছে। ঠাণ্ডা একটা হিমেল হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। মোহিনী হঠাৎই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে “যত্তসব বাজে কথা” বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল রজত। বইটা রেখে আলোটা নিভিয়ে দিল। আজ আর তার কিছু ভালো লাগছেনা।

কিন্তু মাঝরাতে যখন মোহিনী তাকে কাছে টেনে নিল, তার মধ্যে কামনার প্রবৃত্তি জেগে উঠল। সবই ঠিকঠাক ছিল, শুধু মোহিনীর শরীরটা তার যেন অসম্ভব শীতল মনে হল। এই প্রথম তাদের দৈহিক সম্পর্ক, কিন্তু রজত যেন সম্পূর্ণভাবে তা উপভোগ করতে পারল না। নিজেকে তার যেন একটা যন্ত্র বলে মনে হল।

মিলন শেষে রজত এলিয়ে পড়েছিল। শরীরটা যেন নিস্তেজ। হঠাৎই দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজাটা খুলে গেল। চমকে উঠে পাশ ফিরতেই দেখল মোহিনী পাশে নেই। গেল কোথায়? হঠাৎই বারান্দার দিকে নজর গেল। বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে? মোহিনী না? কিন্ত এ কোন মোহিনী? তার দেহটা যেন স্বচ্ছ, তার মধ্যে দিয়ে দুরের আকাশ, চিকচিকে তারা দেখা যাচ্ছে। মোহিনী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। কিন্তু রজত কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিন্তু মন্ত্রের মত যেন তাকে মোহিনী টানছে। সে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোহিনী তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু এই জড়ানো যেন প্রেমিকার আলিঙ্গন নয়। এ যেন অজগরের আলিঙ্গন। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সে চিৎকার করতে গেল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না। তার গোটা শরীরটা যেন বরফ জলে ডুবে যাচ্ছে। মোহিনীর লিপস্টিকে রাঙা সুন্দর দুটি ঠোঁটের পাশ দিয়ে ভয়াল একজোড়া ছুঁচলো দাঁত বেরিয়ে আসছে কেন? এরকম কি কোন স্বাভাবিক মানুষের হয়? এক ঝাঁকুনি দিয়ে রজতের গলাটা তার দিকে টেনে নিয়ে মোহিনী দাঁত বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তা দিয়ে মোহিনী যেন কতদিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। রজতের শরীরটা যেন খাঁচায় পোরা পাখির মত ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। তাকে পালকের মত তুলে নিয়ে হোটেলের তিনতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মোহিনী। সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজেই হয়ত নিচে পড়ার আওয়াজটা চাপা পড়ে গেল। জিঘাংসা ভরা দৃষ্টিতে নিচে একবার তাকিয়েই মোহিনী ধোঁয়ার মত বাতাসে মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে হোটেলের এক কর্মচারী রজতের মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। চোখদুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। শরীরটা যেন রক্তশূন্য কাঠের মত পড়ে রয়েছে। কেউ যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। গলার বাঁদিকে দুটো গোল সমান্তরাল ক্ষতচিহ্ন। আস্তে আস্তে তার চারপাশের ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। পুলিশকে খবর দিতে হবে।

No comments:

Post a Comment