Pages

Finance and Travel Ideas

Sunday 22 July 2018

কায়াহীনের কাহিনী।

স্বামীর কথা আজও মনে পড়ে সুমিতার। স্বামী অল্প বয়েসেই তাকে ছেড়ে চলে যায়, কারণ সেই দুরারোগ্য ব্যাধি, ক্যান্সার। স্বামী তাকে খুবই ভালবাসত, অভাবের সংসার হলেও তাদের আনন্দের কোন অভাব ছিল না। হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত রাজীবের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ল। সুমিতার একমাত্র অপছন্দের কারণ ছিল রাজীবের চেন স্মোকিং আর সেটাই কাল হল। মাত্র ৩১ বছর বয়েসেই এই পৃথিবী ছেড়ে তাকে চলে যেতে হল। সুমিতা একা হয়ে গেল। এক ঝটকায় তার সুন্দর জীবনে অন্ধকার নেমে এল। সে কোনরকমে একটা চাকরি জোগাড় করল কিন্তু মনে আর শান্তি রইল না।

স্বামী মারা যাবার পর বেশ কয়েকমাস হয়ে গেছে। সে অফিসে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পাচ্ছিল না। বসের বকাবকি খেয়ে মনমেজাজ বেশ খারাপ। সোমবার অফিসে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তার টেবিলের ওপরেই ফাইলটা পড়ে রয়েছে। আশেপাশের সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করল কেউ নিজে থেকে ফাইলটা খুঁজে পেয়ে দিয়ে গেছে কিনা। কেউই কিছু বলতে পারল না। সুমিতা এর কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না। যাই হোক, এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি সে আর মাথা ঘামাল না। হয়ত কোন উপকারী বন্ধু, যে নিজের পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক।

কয়েকদিন পরের কথা। সুমিতা নিজের ঘরে বসে রয়েছে। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামতে যায়। হঠাৎ মনে হল যেন পাশের ঘর থেকে কেউ খুব আস্তে বেহালা বাজাচ্ছে। গাটা যেন ছমছম করে উঠল তার। রাজীবও বেহালা বাজাতে খুব ভালবাসত। কিন্তু এ কি করে সম্ভব? পাশের ঘরে একবার গিয়ে দেখবে নাকি? সাহস করে একবার দরজাটা ঠেলে দেখল আবছা অন্ধকারের মধ্যে যে দোলান চেয়ারে বসে রাজীব মাঝে মধ্যে বেহালা বাজাত, সেই চেয়ারটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে দুলছে। সারা শরীরে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল সুমিতার। তবে কি রাজীবের অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারেনি? তার আশেপাশেই ঘুরছে? তাকে ভুলতে পারছে না? এটা কি শুভ না অশুভ ইঙ্গিত? সুমিতা আর ভাবতে পারছে না।

আরেকদিনের কথা। সুমিতা বাজার করে সকালবেলা ফিরছিল। বাজারের আগে রাস্তাটা পার করতে গিয়ে মনে হয় একটু অন্যমনস্কই হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই সামনে চলে এল যমদূতের মত এক প্রকাণ্ড লরি। সুমিতার মনে হল বোধহয় এই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। আর তার বাঁচা হল না। হঠাৎই লরির ড্রাইভার যেন কি দেখে ভয়ে প্রাণপণ চিৎকার করে সশব্দে ব্রেক কষল। সুমিতা চোখ বন্ধ করেই ফেলেছিল। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে যে সে বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং লরিটা ঠিক তার দুহাত সামনে থেমে রয়েছে। সম্পূর্ণ অলৌকিক ব্যাপার। আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সুমিতা বাড়ি ফিরে এল। ড্রাইভারটা তখনও “ভুত ভুত” বলে বিড়বিড় করছে।   

আরও কয়েকদিন পরের কথা। দুপুরের রান্না চাপিয়ে চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল সুমিতা। কখন যে চোখের পাতাদুটো ভারি হয়ে এসেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ রান্না পোড়া যাওয়ার গন্ধে তার চটকা ভাঙল। একি? রান্নাঘরে তো পুরো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে! গ্যাস সিলিন্ডারটা লিক করেছে নির্ঘাত। এইবার তার আর পরিত্রাণ নেই। চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করল। হঠাৎ করে কে যেন এক বালতি জল রান্নাঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। তাজ্জব ব্যাপার। সুমিতা দেখল জাদুমন্ত্রের মত আগুনটা নিভে গেল। এইভাবে সে আরেকবার ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেল। মনে মনে সে সেই অশরীরী অথচ উপকারী বন্ধুকে ধন্যবাদ জানাল। 

আরেকদিনের ঘটনা। অফিস থেকে বেরোতে বেশ দেরিই হয়ে গেছিল সুমিতার। তার বাড়ির আগে একটা পার্ক পড়ে যেখানে রাত্রিবেলা কিছু সমাজবিরোধী আস্তানা গাড়ে। পার্কটার কাছে পৌঁছে লক্ষ্য করল তিন চারজন লোক তার পিছু নিয়েছে। সে ভয় পেয়ে পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু লোকগুলোও চলার গতি বাড়াল। খারাপ মতলবই মনে হচ্ছে। মনে মনে সুমিতা ইষ্টনাম জপ করতে লাগল। হঠাৎই দুটো লোক লাফ দিয়ে পড়ে সামনে রাস্তা আটকাল। মুখে একটা অশ্লীল মন্তব্য করে তার দিকে এগিয়ে এল। আজকাল মেয়েরা আত্মরক্ষার জন্য লঙ্কার স্প্রে, ছোট ছুরি এবং আরও অন্যান্য জিনিস সঙ্গে রাখে। দুর্ভাগ্যবশত আজ ও রকম কিছুই তার সঙ্গে নেই। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এল। নাহ, আজ নিজের সম্মানটুকু রক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না। হঠাৎই জাদুমন্ত্রের মত একটা ব্যাপার ঘটে গেল। একদম সামনের লোকটাকে অদৃশ্য কেউ যেন এক ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দিল। পাশের জনকে কেউ যেন জামার কলার ধরে মাটি থেকে হাতখানেক উপরে তুলে দিয়েছে। ভয়ে হাত পা ছুঁড়ছে লোকটা। ব্যাপার স্যাপার দেখে অন্য দুটো লোক বেশ ঘাবড়ে গেল। পিছু ফিরে দে দৌড়। এরকম কাণ্ড কারখানা জীবনে তারা দেখেছে বলে মনে হয় না। সুমিতার সামনের দুটো লোকও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাল। সুমিতা কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে পায়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিল। আজও সে এক ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেল। রাজীব যেন অন্য জগতে গিয়েও তাকে ভুলতে পারেনি। কায়াহীন অস্তিত্ব নিয়েও তাকে সবসময় অনুসরণ করে চলেছে এবং সব রকম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে। সুমিতা মনে মনে ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল এই ভেবে যে এই অলৌকিক ঘটনা খুব কম লোকের জীবনেই ঘটে আর সে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। এক অপূর্ব প্রশান্তিতে তার মন ভরে উঠল।