Pages

Finance and Travel Ideas

Sunday 25 February 2018

বর্ষার সেই রাত।

ছোটবেলা থেকেই অর্ণবের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। পড়াশোনায় সে খুব ভালো ছিল বলে সেই স্বপ্ন তার পূরণও হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে সে খুব ভালো নম্বর পেয়ে সে এমবিবিএস পাশ করেছে। কিন্তু এবার ইন্টার্নশিপের জন্য তাকে এক বছর কলকাতার বাইরে কোন হাসপাতালে গিয়ে কাজ করতে হবে। ক্যানিং এর বাসন্তী ব্লকে তার পোস্টিং পড়ল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে রওনা হল। নতুন হাসপাতালের দায়িত্ব তার ভালই লাগল। সিনিয়ররা এবং সহকর্মীরা বেশ ভালো। গ্রামের লোকজনেরও ডাক্তারবাবুদের ওপর অগাধ বিশ্বাস। অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল অর্ণব। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাঝে মধ্যেই তাকে বসতে হয় এবং তার কাছে জ্বরজারি বিবিধ সমস্যা নিয়ে লোকেরা আসে এবং সে সাধ্যমত তাদের রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করে। এইভাবে চলছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎই এমন একটা ঘটনা অর্ণবের জীবনে ঘটল যুক্তিতে যার কোন ব্যাখা মিলবেনা।

বর্ষাকাল চলছে। সারাদিন ধরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সন্ধেবেলা ডিউটি থেকে ফিরে অর্ণব একটু মুড়ি চানাচুর নিয়ে বসেছে, হঠাৎই সদর দরজাটা কে যেন সজোরে ধাক্কাতে আরম্ভ করল, "ডাক্তারবাবু, বাড়িতে আছেন? দয়া করে দরজাটা খুলুন।" অর্ণব খুব বিরক্ত বোধ করল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর একটু বিশ্রামের অবকাশ, তাও উপায় নেই। সে বলল, "আমি খুবই ক্লান্ত। তাছাড়া আমাদের হাসপাতালের বাইরে প্র্যাকটিস করা নিয়ম নেই, আপনি এখন যান।" কিন্তু নাছোড়বান্দা কণ্ঠস্বরটি বলল, "হুজুর, একবার চলুন, আমার বাবার ধুম জ্বর, কিছুতেই কমছে না। বাড়ি বেশি দূর না, আর কাউকে পেলাম না বলে আপনার কাছেই এলাম।" অর্ণব আরও দুএকবার আপত্তি করল, কিন্তু লোকটি কিছুতেই শুনল না। অগত্যা সে দরজাটা খুলল। দরজা খুলতে না খুলতেই কড়কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেটুকু দেখতে পেল তাতে মনে হল রোগাপাতলা চেহারার একটি মাঝবয়সী গ্রাম্য লোক, আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা, মুখটাও ভালো করে খেয়াল করা যাচ্ছে না। সে চট করে একটা ছাতা আর তার ডাক্তারি সরঞ্জামের ব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে লোকটির পিছন পিছন চলতে লাগল। একে তো অন্ধকার গ্রামের রাস্তা, তার ওপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, যেন সামনের লোকটি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। লোকটি এতো দ্রুতগতিতে হাঁটছে যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না, খালি পিছিয়ে পড়ছে। তখন একটু হাঁকডাক দিয়ে  নিশ্চিত হচ্ছে যে লোকটি সঙ্গে আছে। বেশ কিছুটা পথ চলার পরে দূরে যেন একটা চালাঘর দেখা গেল। পথপ্রদর্শক লোকটি বলল, "ডাক্তারবাবু, আমাদের বাড়ি এসে গেছে।" আবার একটা বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেটুকু দেখা গেল, লোকটি আর তার পাশে নেই। চমকে গিয়ে অর্ণব ডাকতে লাগল, "ও মশাই, কোথায় গেলেন, ও মশাই?" লোকটি যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। বাধ্য হয়েই সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে চালাঘরটির দিকেই এগোতে লাগল। চালাঘরটির কাছে পৌঁছে দেখল যেন বিছানায় কেউ শুয়ে রয়েছে এবং আশেপাশে আরও কয়েকটি ছায়ামূর্তি ঘোরাফেরা করছে। অন্ধকারে কারোরই মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। অর্ণবকে দেখে কে যেন বলে উঠল, "বড় দেরি করে ফেললেন ডাক্তারবাবু, আর বোধহয় বাঁচবে না।" মহিলার গলায় একটা বুকফাটা কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। অর্ণবের কাছে সবই যেন কেমন ধোঁয়াশার মত লাগছে, তবুও একজন ডাক্তারের কর্তব্য পালনার্থে সে রোগীর পাশে বসে তার নাড়িটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু একি? চাদরের তলা থেকে যে হাতটি সে তুলে ধরল, তার স্পর্শ এত ঠাণ্ডা কেন? এতো রক্তমাংসের হাত নয়। এতো কংকালের হাত! আর তার চারপাশে কারা ভিড় করে এগিয়ে আসছে? এরা কি মানুষ? মানুষ এমন হয়? মনে হচ্ছে গায়ে চাদর জড়ানো একদল কংকাল, শুধু খুলিগুলো দেখা যাচ্ছে। সেগুলো যেন বীভৎসভাবে হাসতে হাসতে অর্ণবের দিকে চেয়ে বলছে, "আর তোর রক্ষা নেই, আজ আর তুই বাঁচলি না।" ছায়ামূর্তিগুলোর অন্ধকার তাকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই অর্ণব জ্ঞান হারাল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন এখন আরও জোরে জোরে পড়ছে।

পরের দিন সকালে গ্রামবাসীরা অর্ণবের মৃতদেহটা উদ্ধার করল। সারা শরীরে যেন এক ফোঁটাও রক্ত অবশিষ্ট নেই, কেউ যেন শুষে নিয়েছে। চোখগুলো যেন মরার আগের মুহূর্তে ভয়ংকর কিছু দেখে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। বহু বছর আগে ওই একই দিনে ওই জায়গায় বেশ কিছু লোক মহামারীতে মারা গেছিল। তারপর থেকে নাকি জায়গাটা অভিশপ্ত।

No comments:

Post a Comment