Pages

Finance and Travel Ideas

Wednesday 10 January 2018

নারায়ণপুরের যাত্রী।

পুরোহিত হিসেবে রবীন ভটচাজের যথেষ্টই নামডাক। বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে পূজা করার জন্য তাঁর ডাক পড়ে। কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, ও দুর্গাপূজাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রচণ্ড সাহসী মানুষ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, যেই ঋতুই হোক আর যেই সময়ই হোক না কেন, তাকে ডাকলে তিনি আসেননি, এমন কোনদিনও হয়নি। তাঁর সুখ্যাতি শুনে একবার নারায়ণপুর জমিদারবাড়ি থেকে ডাক পড়ল কালীপূজা করার জন্য। কিন্তু নারায়ণপুর তাঁর গ্রাম থেকে অনেকটাই দূর, সকালে যদি রওনা হন, তবে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছাতে পারবেন। তাই তিনি সকাল সকালই যাওয়া মনস্থির করলেন। যখনকার কথা বলছি তখন যানবাহনের ব্যবস্থা এত উন্নত হয়নি। রবীনবাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটি সাইকেল, তাই চেপেই তিনি যাত্রা শুরু করলেন। যাবার সময় সেরকম কিছু উল্লেখযোগ্য না ঘটলেও একটা কালো বিড়াল রাস্তা কাটল। তিনি সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে দুবার দুর্গা দুর্গা জপ করে আবার চলতে শুরু করলেন। অনেকখানি রাস্তা, তার ওপর আকাশটা যেন একটু মেঘলা হয়ে রয়েছে।

গ্রামের মেঠো পথ, মাঝেমধ্যে দু একটা বাড়ি চোখে পড়ে, সেগুলো ছাড়ালেই আবার একটুখানি হয়ত জঙ্গল। প্রায় দুপুর হয়ে এল। পরিশ্রান্ত রবীনবাবু সাইকেল দাঁড় করিয়ে সঙ্গে যে মুড়ি জল নিয়ে বেড়িয়েছিলেন, তাই একটু খেয়ে নিলেন। গাছের তলায় একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে এল। রাস্তায় জনমানবের সংখ্যা যেন ক্রমশ কমতে লাগল। তবে তাদেরই দুএকজনকে জিজ্ঞাসা করে আশ্বস্ত হলেন যে রাস্তা ভুল হয়নি। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। তিনি জেনে নিয়েছিলেন যে নারায়ণপুর গ্রামে পৌঁছোবার আগে একটা পুরানো পরিত্যক্ত মন্দির পড়বে। হিসেবমত এতক্ষণে সেই মন্দিরের কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া উচিত। কিন্তু রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। চলছেন তো চলছেনই। অন্ধকার নামায় পথ দেখতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎই তাঁর মনে হল, ডানদিকে যেন কয়েকটা চালাঘর দেখতে পেলেন। হয়ত ওইদিকেই নারায়ণপুর পড়বে। আশান্বিত হয়ে জোরে প্যাডেলে চাপ দিলেন। ঘরগুলির কাছে পৌঁছে নেমে পড়লেন। একটা ঘরের উঠোনে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে হাঁক দিলেন, "কেউ ঘরে আছেন? এটা কি নারায়ণপুর?" কেউ কোন উত্তর দিল না। রবীনবাবু আরেকবার ডাকলেন, "কেউ আছেন ঘরে?" হঠাৎ জাদুমন্ত্রের মত তাঁর সামনে যেন একটি স্ত্রীলোক আবির্ভূত হল। "আসুন ঠাকুরমশাই। ঘরে কেউ নেই। তবে এসে যাবে।" গলাটা যেন একটু খোনা। রবীনবাবু একটু ইতস্তত করলেন। স্ত্রীলোকটি বলল, "যান আপনি ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আপনার জন্য দুটো জলখাবারের ব্যবস্থা করিগে।" অগত্যা তার কথামত ঘরে গিয়ে বসলেন। ঘরে শুধু টিমটিম করে একটা পিদিম জ্বলছে। তারই আবছা আলোয় ঘরে এদিক ওদিক কি আছে দেখার চেষ্টা করছেন, এমনই সময় স্ত্রীলোকটি ফিরে এল। আচমকা লক্ষ করলেন, তার সামনে একটা বাটিতে মুড়ি আর বাতাসা রাখা আছে, পাশে এক গেলাস জল। স্ত্রীলোকটি একটু দূরে বসে তাঁকে দেখতে লাগল। যথেষ্টই ক্ষুধার্ত ছিলেন, অতএব খেতে শুরু করলেন। কিন্তু যতই খাচ্ছেন, মুড়ি আর বাতাসা যেন ফুরাচ্ছে না। এতো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। বাধ্য হয়ে খাওয়া থামিয়ে জলের গেলাস থেকে জল খেলেন, সেখানেও একই কাণ্ড। জল খেয়ে গেলাসটা রাখা মাত্রই আবার সেটা ভর্তি হয়ে গেল। হঠাৎই একটা হাড়হিম করা হাসির আওয়াজে তিনি চমকে উঠলেন। স্ত্রীলোকটি নিমেষের মধ্যে তাঁর একদম পাশে চলে এসেছে। হাসতে হাসতে বলল, "ঠাকুরমশাই, আপনার ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটেছে তো?" রবীনবাবু কোনরকমে ঘাড় নাড়লেন। স্ত্রীলোকটির মুখের হাসি যেন পলকের মধ্যে মুছে গেল, সারা মুখে একটা ভয়াল জিঘাংসাপূর্ণ দৃষ্টি। "এবার আমার তৃষ্ণা কে মেটাবে?" বলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রবীনবাবুকে জাপটে ধরল। রবীনবাবু যথেষ্ট শক্তিশালী মানুষ, কিন্তু স্ত্রীলোকটির শক্তি যেন তাঁর চারগুণ। কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না, দম আটকে এল। ঘাড়ের ওপর স্ত্রীলোকটির হিমশীতল নিঃশ্বাস পড়ছে আর দুটি ছুঁচের মত ধারালো কিছু যেন তাঁর চামড়াকে স্পর্শ করছে। আস্তে আস্তে সে দুটি ফলা যেন তাঁর ঘাড়ে প্রবেশ করছে, রবীনবাবু অনুভব করলেন তাঁর পরনের পাঞ্জাবিটা যেন ভিজে যাচ্ছে। রক্ত? জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে মনে হল যেন একটা ভয়ংকর মিশকালো প্রেতমূর্তি তাঁর বুকের ওপর বসে রক্তপিপাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে।

1 comment: