বাংলোবাড়িটায় ওরা নতুনই এসেছে। ওরা বলতে জয়িতা, তার বাবা মা, ছোট ভাই শুভাশিস এবং পোষা আলসেশিয়ান টমি। জয়িতার বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বদলির চাকরি, তাই বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। জয়িতা ও তার ভাই দুজনেই স্কুলে পড়ে, চার বছরের ছোট বড়। কিন্তু যবে থেকে তারা এখানে এসেছে, কিছু একটা অশুভ ছায়া যেন তাদের তাড়া করে ফিরছে। তারা যখন গাড়ি থেকে নেমে বাংলোতে ঢুকছিল, একটা আধপাগলা লোক পাশ দিয়ে বলতে বলতে বেরিয়ে গেল, “এ বাড়িতে এসেছ তোমরা? চলে যাও, এখুনি চলে যাও, মরবে, এ বাড়িতে থাকলেই সব মরবে!” সবার মনে যেন একটা অশুভ ইঙ্গিত খেলে গেল।
একদিন শুভাশিস দিদিকে বলল, "দিদি, তুই এখানে রাত্রিবেলা কোন আওয়াজ শুনতে পেয়েছিস?" জয়িতা বলল, "কই নাতো?" শুভাশিস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “আমি যেন রাত্রিবেলা কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কাঁদছে।“ জয়িতা বলল, “দুর বোকা, ও তোর মনের ভুল।“ ব্যাপারটা আর বেশিদুর গড়াল না।
একদিন বাজার করতে গিয়ে জয়িতার বাবার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আলাপ হল। ওদের বাংলো ছাড়িয়ে গেলে একটা মাঠ পড়ে, তার পাশেই ওনার বাড়ি। কথায় কথায় বাংলোটার প্রসঙ্গ এসেই গেল। ওরা ওই বাংলোতে উঠেছে শুনেই ভদ্রলোক যেন একটু থম মেরে গেলেন। জয়িতার বাবা কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন, “ওই বাড়িতে বহু বছর আগে একটা খুন হয়। স্ত্রীর সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্ক আছে সন্দেহে স্বামী স্ত্রীকে খুন করে। এর কিছুদিন পরে স্বামীরও অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়। এর পর যারা যারাই ওখানে থেকেছে, তাদেরই কোন না কোনভাবে অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। ও বাড়ি ভাল নয় মশাই, অভিশপ্ত।“ বলেই ভদ্রলোক জোর পায়ে হাঁটা দিলেন। জয়িতার বাবা চিন্তাচ্ছন্ন মনে বাড়ি ফিরে এলেন। তবে কাউকে কিছু বললেন না।
আরেকদিনের কথা। পরের দিন কেমিস্ট্রি পরীক্ষা, একটু বেশি রাত জেগেই পড়ছে জয়িতা। পড়ার ঘরের পাশে একটা বারান্দা, লাগোয়া একটা জানলাও আছে। হঠাৎই মনে হল, বারান্দা দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি চলে গেল। এতো রাতে বাড়ির আর তো কেউ জেগে থাকার কথা নয়। চট করে বারান্দায় গিয়ে দেখল কেউ নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার যেন একটা আওয়াজ আসছে। গায়ে কাঁটা দিল জয়িতার। তাড়াতাড়ি সে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
পরের দিন সকালে প্রাতরাশ করতে করতে সকলের খেয়াল হল, টমি তো নেই। খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে বাগানের এককোণে ঝোপের নিচে টমির মৃতদেহটা পাওয়া গেল। অতবড় কুকুরটার কে যেন ঘাড়টা মটকে দিয়েছে। অশুভ একটা ইঙ্গিতে সবার যেন গা ছমছম করে উঠল। শুভাশিসের খুবই প্রিয় ছিল টমি, স্কুল থেকে এসেই তার সঙ্গে খেলা তার চাইই চাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “টমির এই অবস্থা কে করল? ও কার কি ক্ষতি করেছিল?” কারো কাছেই কোন সদুত্তর নেই।
পরের দিন জয়িতার বাবা অনেক রাত অবদি জেগে কিছু অফিসের কাজ করছিলেন। তার স্টাডির লাগোয়া একটা বারান্দা আছে এবং ঘরটা তিনতলায়। হঠাৎ তার মনে হল বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় তো বাড়ির কেউ এখানে থাকার কথা নয়। ভয়ে তার গাটা ছমছম করে উঠল। একই সঙ্গে কৌতূহলও হল। তিনি কাজের ডেস্ক থেকে উঠে বারান্দায় গেলেন। কই, কেউ নেই তো? একটু এগিয়ে রেলিংএর কাছটায় গেলেন। হঠাৎ মনে হল পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। পিছু ফিরে দেখতে যাবেন, কে যেন তাকে একটা জোর ধাক্কা মারল। রেলিঙটা নিচু, তার শরীরটা একটা পাক খেয়ে শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে একটু নড়েচড়েই স্থির হয়ে গেল।
পরের দিন বাড়ির অবস্থাটা চিন্তা করাই যায়। সবাই শোকস্তব্ধ, শোকসন্তপ্ত। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে এটাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না। কোনরকমে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আপাতত নেওয়া হবে, বাকি পরে ব্যবস্থা করা যাবে। গাড়ি আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যেই হয়ে গেল। পুরোনো অ্যামবাসাডার গাড়ি, ধীরে ধীরে চলছে। ড্রাইভারের মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জয়িতা অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, “আপনি গাড়িটা প্লিজ জোরে চালান, আমাদের ট্রেন ধরতে হবে।“ ড্রাইভারের কোন ভাবান্তর নেই। হঠাৎই গাড়িটা একটা অজানা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চলার পরে একটা জঙ্গলের কাছে এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার তাদের দিকে মুখ ফেরাল। ওরকম বীভৎস মুখ তারা জীবনে দেখেনি। মুখটা যেন সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে, তাতে রক্তবর্ণ দুটো চোখ। ড্রাইভার বলল, “আপনারা পৌঁছে গেছেন।“ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যেন হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। হঠাৎই মনে হল গাড়িটাকে কেউ ঠেলছে। কিন্তু পিছন দিকে তাকিয়ে তারা কাউকে দেখতে পেল না। দরজা খোলার চেষ্টাও বৃথা হল। আচমকা গাড়িটা যেন কিছুটা নিচের দিকে গোঁত্তা খেয়ে নেমে গেল এবং জলে কিছু পড়লে ঝপাং করে যেমন আওয়াজ হয় তেমনই একটা আওয়াজ হল। তবে কি গাড়িটা একটা পুকুরে পড়ল? তারা তো কেউই সাতাঁর জানে না। আর সাতাঁর জেনেও বা লাভ কি, প্রাণপণ চেষ্টাতেও গাড়ির দরজা খোলা সম্ভব হচ্ছে না। আস্তে আস্তে জলের রেখা গাড়ির জানলা ছাড়িয়ে উঠতে শুরু করল, ডুবছে, গাড়ি ডুবছে, চারিদিকে যেন একটা হিমশীতল স্তব্ধতা, শেষ মুহূর্তে শুধু কয়েকটা মর্মান্তিক আর্তনাদ। কয়েকটা বুদবুদ ছড়িয়ে দিয়ে গাড়িটা পুরোপুরি পুকুরের জলে তলিয়ে গেল।
একদিন শুভাশিস দিদিকে বলল, "দিদি, তুই এখানে রাত্রিবেলা কোন আওয়াজ শুনতে পেয়েছিস?" জয়িতা বলল, "কই নাতো?" শুভাশিস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “আমি যেন রাত্রিবেলা কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কাঁদছে।“ জয়িতা বলল, “দুর বোকা, ও তোর মনের ভুল।“ ব্যাপারটা আর বেশিদুর গড়াল না।
একদিন বাজার করতে গিয়ে জয়িতার বাবার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আলাপ হল। ওদের বাংলো ছাড়িয়ে গেলে একটা মাঠ পড়ে, তার পাশেই ওনার বাড়ি। কথায় কথায় বাংলোটার প্রসঙ্গ এসেই গেল। ওরা ওই বাংলোতে উঠেছে শুনেই ভদ্রলোক যেন একটু থম মেরে গেলেন। জয়িতার বাবা কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন, “ওই বাড়িতে বহু বছর আগে একটা খুন হয়। স্ত্রীর সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্ক আছে সন্দেহে স্বামী স্ত্রীকে খুন করে। এর কিছুদিন পরে স্বামীরও অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়। এর পর যারা যারাই ওখানে থেকেছে, তাদেরই কোন না কোনভাবে অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। ও বাড়ি ভাল নয় মশাই, অভিশপ্ত।“ বলেই ভদ্রলোক জোর পায়ে হাঁটা দিলেন। জয়িতার বাবা চিন্তাচ্ছন্ন মনে বাড়ি ফিরে এলেন। তবে কাউকে কিছু বললেন না।
আরেকদিনের কথা। পরের দিন কেমিস্ট্রি পরীক্ষা, একটু বেশি রাত জেগেই পড়ছে জয়িতা। পড়ার ঘরের পাশে একটা বারান্দা, লাগোয়া একটা জানলাও আছে। হঠাৎই মনে হল, বারান্দা দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি চলে গেল। এতো রাতে বাড়ির আর তো কেউ জেগে থাকার কথা নয়। চট করে বারান্দায় গিয়ে দেখল কেউ নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার যেন একটা আওয়াজ আসছে। গায়ে কাঁটা দিল জয়িতার। তাড়াতাড়ি সে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
পরের দিন সকালে প্রাতরাশ করতে করতে সকলের খেয়াল হল, টমি তো নেই। খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে বাগানের এককোণে ঝোপের নিচে টমির মৃতদেহটা পাওয়া গেল। অতবড় কুকুরটার কে যেন ঘাড়টা মটকে দিয়েছে। অশুভ একটা ইঙ্গিতে সবার যেন গা ছমছম করে উঠল। শুভাশিসের খুবই প্রিয় ছিল টমি, স্কুল থেকে এসেই তার সঙ্গে খেলা তার চাইই চাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “টমির এই অবস্থা কে করল? ও কার কি ক্ষতি করেছিল?” কারো কাছেই কোন সদুত্তর নেই।
পরের দিন জয়িতার বাবা অনেক রাত অবদি জেগে কিছু অফিসের কাজ করছিলেন। তার স্টাডির লাগোয়া একটা বারান্দা আছে এবং ঘরটা তিনতলায়। হঠাৎ তার মনে হল বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় তো বাড়ির কেউ এখানে থাকার কথা নয়। ভয়ে তার গাটা ছমছম করে উঠল। একই সঙ্গে কৌতূহলও হল। তিনি কাজের ডেস্ক থেকে উঠে বারান্দায় গেলেন। কই, কেউ নেই তো? একটু এগিয়ে রেলিংএর কাছটায় গেলেন। হঠাৎ মনে হল পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। পিছু ফিরে দেখতে যাবেন, কে যেন তাকে একটা জোর ধাক্কা মারল। রেলিঙটা নিচু, তার শরীরটা একটা পাক খেয়ে শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে একটু নড়েচড়েই স্থির হয়ে গেল।
পরের দিন বাড়ির অবস্থাটা চিন্তা করাই যায়। সবাই শোকস্তব্ধ, শোকসন্তপ্ত। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে এটাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না। কোনরকমে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আপাতত নেওয়া হবে, বাকি পরে ব্যবস্থা করা যাবে। গাড়ি আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যেই হয়ে গেল। পুরোনো অ্যামবাসাডার গাড়ি, ধীরে ধীরে চলছে। ড্রাইভারের মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জয়িতা অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, “আপনি গাড়িটা প্লিজ জোরে চালান, আমাদের ট্রেন ধরতে হবে।“ ড্রাইভারের কোন ভাবান্তর নেই। হঠাৎই গাড়িটা একটা অজানা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চলার পরে একটা জঙ্গলের কাছে এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার তাদের দিকে মুখ ফেরাল। ওরকম বীভৎস মুখ তারা জীবনে দেখেনি। মুখটা যেন সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে, তাতে রক্তবর্ণ দুটো চোখ। ড্রাইভার বলল, “আপনারা পৌঁছে গেছেন।“ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যেন হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। হঠাৎই মনে হল গাড়িটাকে কেউ ঠেলছে। কিন্তু পিছন দিকে তাকিয়ে তারা কাউকে দেখতে পেল না। দরজা খোলার চেষ্টাও বৃথা হল। আচমকা গাড়িটা যেন কিছুটা নিচের দিকে গোঁত্তা খেয়ে নেমে গেল এবং জলে কিছু পড়লে ঝপাং করে যেমন আওয়াজ হয় তেমনই একটা আওয়াজ হল। তবে কি গাড়িটা একটা পুকুরে পড়ল? তারা তো কেউই সাতাঁর জানে না। আর সাতাঁর জেনেও বা লাভ কি, প্রাণপণ চেষ্টাতেও গাড়ির দরজা খোলা সম্ভব হচ্ছে না। আস্তে আস্তে জলের রেখা গাড়ির জানলা ছাড়িয়ে উঠতে শুরু করল, ডুবছে, গাড়ি ডুবছে, চারিদিকে যেন একটা হিমশীতল স্তব্ধতা, শেষ মুহূর্তে শুধু কয়েকটা মর্মান্তিক আর্তনাদ। কয়েকটা বুদবুদ ছড়িয়ে দিয়ে গাড়িটা পুরোপুরি পুকুরের জলে তলিয়ে গেল।
No comments:
Post a Comment