Pages

Finance and Travel Ideas

Monday 27 January 2020

My journey as an actor....

It all started in 2016 when I got my first opportunity to act in a film. The name of the feature film is Bhalobasar Tane and it was shot in Dakshin Barasat. I acted as a professor of a local college in this film who is scolding truant students. The name of the director is Susanta Paul Chowdhury. After that I also acted in Tushar Mazumdar's Swapnate Sesh. Following these two, there was a long gap. My first break as a talkie artist came from Joyee, a mega shown on Zee Bangla. This was in June 2019. Since 2019, I have been acting regularly in megas. Loukik na Aloukik, Srimoyee, Police Filez, Durga Durgeshwari, Netaji, Joy Baba Lokenath, Kone Bou, Ke Apon Ke Por, Karunamoyee Rani Rashmoni, Nishir Dak, Chuni Panna, Baghbandi Khela, Ekhane Akash Neel and last but not least Irabotir Chupkotha are some of the mega serials in which I have worked. Most of the serials are being shown on Star Jalsha and Zee Bangla. I had the opportunity to work under various reputed production houses, namely Sri Venkatesh Films, Surinder Films, Acropolis Entertainment, Shashi Sumeet Productions, Fatfish Entertainment, Magic Moments and so on.


I also had the opportunity to act in a few web series named Karkat Rog and Rahasyo Romancho. The first one was shot in double version (Bengali and Hindi). You can watch it on Zee5. I am there in the 7th episode. The second one is available on hoichoi. Recently, I acted in eminent Bengali actor Saumitra Chatterjee's biopic "Abhijaan" directed by Parambrata Chatterjee which will be released later this year. In September, I had the opportunity to enact a police constable's role in Black Widows, a Zee5 thriller that would be telecasted in a web series format. Black Widows is directed by the much-famed Birsa Dasgupta. After this, the projects in which I worked include Lost (Yami Gautam movie), Mon Mane Na (Colors Bangla), Debi (Sun Bangla), Agnishikha (Sun Bangla), Krishnakali (Zee Bangla), Gnatchora (Acropolis), Haami 2 (Windows), Raktakarabi (web series), Aponjon (short film), Byomkesh Hatyamancha (SVF), Saheber Chithi (Acropolis), Rabindra Kabya Rahasya (Eskay Movies), Khelnabari (Zee Bangla), Hubba (Friends Communication), Manush (Jeetz Filmworks), Nikhoj (Hoichoi), Avishapto (OTT), Mitin Mashi 2 (Camelia Productions), and last but not least Tumii Je Amar Maa (Colors Bangla).    

In the meantime, I enrolled myself in an acting course. It was a four-month course and our mentor Amitavada (Kedar Bose of Bokul Katha) had been pretty helpful to us in understanding the ins and outs of the film and television industry. I am fairly enjoying my stint in this industry and hope to perform well in the coming days. Hope to see you soon! My actor page link is given below:

https://www.facebook.com/SusmitTheActor/?modal=admin_todo_tour


Saturday 2 March 2019

ছবি (সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)।

প্রদীপ ও জয়ন্ত ছোটবেলা থেকেই খুব বন্ধু। যাকে বলে জিগরি দোস্ত। দুজনেরই বারুইপুরে বাড়ি। তারা একই স্কুল এবং কলেজে পড়াশোনা করেছে এবং একসাথে খেলাধুলাও করেছে। কিন্তু ছাত্রজীবন আর কর্মজীবন এক নয়। কর্মসূত্রে হঠাৎই প্রদীপকে বাইরে যেতে হল। তারপর বহু বছর দুজনের মধ্যে চিঠি ছাড়া কোন যোগাযোগ ছিলনা।

আচমকাই প্রদীপ জয়ন্তের কাছ থেকে চিঠি পেল যে তার বাবা মারা গেছেন। মারা যাবার কারণ কিছু চিঠিতে উল্লেখ করা ছিল না। চিঠিটা পেয়ে প্রদীপ কিছুটা ধন্দে পড়ে গেল। তার ছোটবেলার বন্ধুর বাবা গত হয়েছেন, তার তো যাওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত যাবে বলেই ঠিক করে ফেলল। 

বারুইপুরে পৌঁছেই জয়ন্তের বাড়ির দিকে রওনা হল প্রদীপ। পথেই একটা চায়ের দোকানে জয়ন্তের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, বোধহয় নিমন্ত্রণই করছিল। প্রদীপকে দেখে একটু হাসল, চায়ের দোকানে এক কাপ চা খাওয়াল।

কথায় কথায় প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, “কিরে, কি করে হল এসব? কাকু তো সুস্থই ছিলেন।“
জয়ন্ত উত্তর দিল, “বয়সে যা হয় আরকি।“ বলে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হল জয়ন্তের। কিন্তু সে আর কিছু প্রশ্ন করল না।

দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। প্রদীপ আর খুব বেশিদিন বারুইপুরে থাকতে পারবে না, কাজে যোগ দিতে হবে। জয়ন্তের বাড়িতে বাবার শ্রাদ্ধশান্তির জোগাড় চলছে। তাকে সব একাই সামলাতে হচ্ছে, প্রদীপও তাকে বন্ধু হিসেবে সাধ্যমত কাজে কর্মে সাহায্য করছে।

জয়ন্তদের বিরাট দালানবাড়ি এবং তার অনেকগুলি ঘর। তার বাবার একটি ছবি এই ঘরগুলির মধ্যে একটি ঘরে রাখা ছিল। তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। জয়ন্ত প্রদীপকে বলল, "চল, বাবার ছবিটা দোতলার ঘর থেকে নিয়ে আসি।" প্রদীপ তার সঙ্গে দোতলায় সেই ঘরে এল। দরজা খোলাই ছিল। ঘরে ঢুকেই তার যেন কেমন একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি হল। এঘরে যেন না ঢুকলেই ভালো হত।

জয়ন্ত সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। দেওয়ালে মৃত ব্যক্তির ছবিটা টাঙানো ছিল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে যেন প্রদীপের গাটা ছমছম করে উঠল। কেমন যেন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। সে চট করে চোখ সরিয়ে নিল। মাথার মধ্যে এই চিন্তাটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, কতক্ষণে এই ঘরটা থেকে বেরোতে পারবে।

হঠাৎই জয়ন্ত প্রদীপকে বলল, "এই ঘরটা তো এখন আর কাজে লাগছে না, তুই ঘর থেকে বাবার ছবিটা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়া, আমি দরজার চাবিটা নিয়ে আসি।" এই বলে সে নিচে চলে গেল। তার কথামত প্রদীপ দেয়াল থেকে উক্ত ছবিটি নামিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে।

ঘরের আলোর সুইচটা ঘরের দরজা থেকে বেশ আগে ছিল। অর্থাৎ আলো নিবিয়ে তাকে বেশ খানিকটা অন্ধকার পেরিয়ে আসতে হবে। আলো নেবানোর পর মুহূর্তেই তার মনে হল যেন যে জায়গা থেকে সে ছবিটি নিয়ে এল, সেখান থেকে তাকে কেউ চুম্বকের মত টানছে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। সে প্রাণপণ চেষ্টা করল যাতে কিছুতেই সেই ছবি রাখা জায়গাটার দিকে না দেখতে হয়। কিন্তু তবুও সেই একই অনুভূতি। প্রাণপণ চেষ্টায় এবং মনের জোরে নিজের শরীরটাকে সে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। কোনরকমে হাঁপাতে হাঁপাতে সে নিচে নামল। চিৎকার করে “জয়ন্ত, জয়ন্ত” বলে ডাকতে লাগল। থরথর করে কাঁপছে। জয়ন্ত ছুটতে ছুটতে এল। অবস্থা দেখে তাকে একগ্লাস জল এনে দিল। জল খেয়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল প্রদীপ এবং বন্ধুকে সব বলল। বন্ধু সব শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে রইল। তারপর তাকে বলল, “তোকে আমি আগে বলিনি। আমার বাবার অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল।“

প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, ”কি ভাবে?”

জয়ন্ত উত্তর দিল, “বাবার ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতি হওয়াতে দেনায় পড়ে গেছিল। সবসময় চিন্তিত থাকত এই ব্যাপার নিয়ে। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাত। একদিন বোধহয় ওভারডোজ হয়ে গেছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই শেষ। ডাক্তার ডাকারও সময় পাওয়া যায়নি।“

সমস্ত শুনে প্রদীপ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেলে সে আবার কাজে তার শহরে ফিরে গেল। তবে এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন তার মনে দাগ কেটে বসে ছিল। 

(গল্পের কারণে কিছু তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে।)

Saturday 8 December 2018

নয়ন।

নামটি তার নয়ন। যদিও তাকে কারো নয়নের মণি বলা যায় না, কিন্তু গ্রামসুদ্ধ লোক তাকে ভালোবাসে। অনেক ছোটবেলাতেই মা বাবাকে হারিয়েছে সে। গ্রামের লোকেরাই তার দেখভাল করেছে। লেখাপড়া তার খুব বেশিদূর হয়নি। কোনরকমে টেনেটুনে ক্লাস এইট। গ্রামে এর ওর ফাইফরমাস খাটে, দুপয়সা যা রোজগার হয়, চলে যায়। গ্রামের লোকেরাই একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

গ্রামের নাম গোবিন্দপুর (কাল্পনিক)। পশ্চিমবঙ্গের কোন একটি জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। নয়ন থাকে একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে। আজ থেকে বহু বছর আগে ওই কুঁড়েঘরে এক তান্ত্রিক এসে আশ্রয় গেড়েছিল। তান্ত্রিকেরা সাধারণত একজায়গায় খুব বেশিদিন থাকে না। একদিন সেও গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেল। তাই গ্রামের লোকেরা নয়নকে বলল, “কুঁড়েটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে, তুইই থাক ওখানে। তোর জন্য আলাদা ঘর করে দেওয়া অনেক খরচার ব্যাপার। পরে দেখা যাবে।“ নয়ন তাতেই রাজি হল। অন্ন বস্ত্রের জন্য তার চিন্তা নেই, বাসস্থানও সে পেয়ে গেল। গ্রামের লোকেরাই তার বিছানা, তোষক ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিল।

নয়নের বহুদিনের অভ্যাস অবসর সময়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো। এই করতে গিয়ে সে অনেক কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। তবে কোনটাই খুব ভীতিপ্রদ নয়।

একদিন সন্ধ্যেবেলা নয়নের হাতে কোন কাজ ছিল না। সে মাঝে মাঝেই ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের শ্মশানের কাছে চলে যেত। অন্য লোকেরা যেখানে শ্মশানকে এড়িয়ে চলে, সেখানে নয়ন নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। নির্জনতা যেন তাকে আকর্ষণ করত।

সে ঘুরতে ঘুরতে শ্মশানের কাছে এসে লক্ষ্য করল, ভিতরে একটা ধুনি জ্বলছে। এখন এইখানে কে ধুনি জ্বালাবে? আশেপাশে কাউকে তো চোখে পড়ছে না। আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক। একটা বড় গাছের আড়াল থেকে সে দেখল, ধুনির পাশে গেরুয়া বসন পরিহিত কে যেন বসে আছে। ধুনির ধোঁয়ায় যেন একটা আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। 

ধুনির পাশে বসে থাকা লোকটাকে একজন সাধুবাবা বলেই মনে হল তার। কিন্তু সাধুবাবার হাতে ওটা কি? ভালো বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু ঠাওর করে দেখতেই চমকে উঠল নয়ন। ওটা তো একটা কাটা মুণ্ডু, যার গলার কাছ দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত সাধুবাবার পায়ের কাছে একটা কঙ্কালের খুলির মধ্যে পড়ছে। সাধুবাবা আবার বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়ছেন। ভয়ে নয়নের গলা শুকিয়ে গেল।

খসখস পায়ের শব্দ হওয়াতেই মনে হয় সাধুবাবা নয়নের উপস্থিতি টের পেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নয়ন ভয়ে চুপ করে রইল, নট নড়নচড়ন না কিছু। কিন্তু সাধুবাবা তাকে কিছু বললেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নয়ন দে দৌড়, দেখতে দেখতে ত্রিসীমানা পার।

গ্রামে পৌঁছে নয়ন কাউকে কিছুই বলল না। কিন্তু তার মনটা খচখচ করতেই থাকল। এত বড় একটা বীভৎস ব্যাপার, চুপ করে থাকাটাও তো উচিত হবে না। নয়ন ভাবল কয়েকদিন অপেক্ষা করা যাক।



বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। গ্রামের মোড়লের কাছে খবর পৌঁছল যে আশেপাশের গ্রাম থেকে নাকি বেশ কয়েকটি বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে। চিন্তায় পড়ে গেল মোড়ল। নয়নও ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। সে খবরটা আর চেপে রাখতে পারল না। বলেই দিল মোড়লকে।

মোড়ল ব্যাপারটা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “যা দেখেছিস, ঠিক দেখেছিস? মনের ভুল নয়তো?” নয়ন বলল, “না গো মোড়লমশাই, আমি ঠিকই দেখেছি।“

মোড়ল বলল, ”ঠিক আছে, আরেকদিন তোর সঙ্গে আমি চুপিচুপি শ্মশানে যাব। দেখি ব্যাপারটা কি হচ্ছে। তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করব।“ নয়ন রাজি হল। একা যেতে হলে হয়ত সাহস পেত না, কিন্তু সঙ্গে মোড়ল থাকবে।   
এই কথামত একদিন সন্ধ্যেবেলা নয়ন মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে সাধুবাবার কাণ্ডকারখানা সব দেখে এল। সেদিন সাধুবাবা শবসাধনা করছিলেন। পাশে কারণবারিও রাখা ছিল। চারিদিকে একটা ভৌতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। তাদের দুজনের উপস্থিতি তিনি টের পাননি বা টের পেলেও তাদের বুঝতে দেননি। তার মনসংযোগ এতটাই বেশি ছিল।
দুজনেই চুপচাপ বাড়ি ফিরে এল। ফেরার পথে মোড়ল তাকে সাবধান করল, “এখনই কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। ভেবে দেখি কি করা যায়।“

রাত তখন বেশ গভীর। মোড়ল নিজের একচালা ঘরে শুয়ে রয়েছে। স্ত্রী অল্পবয়সে বিয়োগ হওয়াতে একাই থাকে, ছেলেমেয়ে হয়নি। সাধুবাবার এই কাণ্ডকারখানা নিয়ে একটু বেশীই চিন্তিত ছিল বলে ঘুম আসতে দেরিই হচ্ছিল। চোখটা যেন একটু বুজে এসেছে, মনে হল অস্ফুট স্বরে কেউ তার নাম ধরে ডাকল। গলাটা যেন চেনাচেনা লাগল তার। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। ওই আবার! কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। আরে! এতো তার স্ত্রী সরমার গলা। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সরমা তো কতদিন আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে কি অন্য কেউ? মোড়ল আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজাটা খুলে ফেলল। 

দরজাটা খুলে প্রথমে পরিষ্কার কিছু দেখতে পেল না। দূরে মনে হল আবছা একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে পা টিপে এগিয়ে চলল। সে যত এগোচ্ছে, ছায়ামূর্তিটাও যেন আরও দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। সে যেন এই ডাকে সম্মোহিত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে মোড়লের দেহটা জঙ্গলের গহীনে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দূরে যেন একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ।

পরের দিন গ্রামের লোকেরা দেখল মোড়লের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, মোড়ল বেপাত্তা। হইহই রব পড়ে গেল। একেকজনের একেকরকম মতামত। শুধু নয়নই চুপ করে রইল। সে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। তবুও সে কাউকে কিছু জানাল না। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে......

মোড়ল নিখোঁজ হবার পর এক সপ্তাহ মত কেটে গেছে। তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। সেদিন রাতের কথা। নয়ন শুয়ে রয়েছে কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মোড়লের কথাটা তার বারবার মনে আসছে। তাকে খুবই ভালবাসত, নিজের সন্তানের মতই দেখত। তার যেকোনো সমস্যার সমাধান মুহূর্তের মধ্যে করে দিত। তার কি হল? তাকে কি সাধুবাবা খুন করেছে? কেনই বা তা করতে যাবে? মোড়লের কোন শত্রু ছিল বলে তার মনে পড়ল না। এমনি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু যেন ঘুমঘুম ভাব এসেছে, হঠাৎই যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকল।

“এই নয়ন!”

চমকে উঠল সে। আরে! এতো পরিষ্কার মোড়লের গলা। তবে কি মোড়ল ফিরে এসেছে? কিন্তু এতদিন ধরে যে লোকটা নিখোঁজ সে হঠাৎ তার কাছে এসেছে কেন? সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।

“এই নয়ন, বাইরে আয়, আমি মোড়লমশাই বলছি!”

নয়নকে কেমন যেন একটা অজানা ভয় গ্রাস করতে থাকে। হঠাৎই তার নিশির ডাকের কথা মনে পড়ে যায়। এ নিশ্চয় নিশির ডাক হবে। ওই সাধুবাবারই কীর্তিকলাপ এটা। সে নিশ্চয় নিশির ডাক ব্যবহার করে কোনভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এবারে তার মনে হল বহু বছর আগে যে তান্ত্রিক এ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছিল এই সাধুবাবা সে ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তার ফাঁদে পা দিয়েই নিশ্চয় মোড়ল প্রাণ হারিয়েছে এবং নিশিতে রুপান্তরিত হয়েছে। এবারে তার পালা। না, সে কিছুতেই এই ডাকে সাড়া দেবে না। মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়।   

“এই নয়ন, বাইরে আসবি তো, আমি মোড়লমশাই বলছি!”

আবার সেই ডাক! নয়ন উঠল না। আর ডাকাডাকি শোনা গেল না। বাকি রাতটা নয়ন জেগেই কাটিয়ে দিল।
পরের দিন সকালে নয়ন একটা খুব গুরুতর সিদ্ধান্ত নিল। সাধুবাবাকে সে নিজের হাতে শেষ করবে। হ্যাঁ, নিজের হাতে। এর জন্যে হয়ত তাকে খুব বড় একটা ঝুঁকি নিতে হবে, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। মনে মনে ঠিক করে ফেলল কি করবে। গ্রামের পুরানো ভাঙা কালীমন্দির থেকে ত্রিশূলটা জোগাড় করতে হবে। চুপিসারে কাজটা সারতে হবে, কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়।

দুপুরের দিকে গ্রামের রাস্তা মোটামুটি নির্জন হয়ে যায়। কাউকে জানান না দিয়ে নয়ন ত্রিশূলটা জোগাড় করে ফেলল। মনে মনে মা কালীর আশীর্বাদও কামনা করল।

সেই রাতটা ছিল বর্ষাবাদলের রাত। নয়নের বুকটা দুরদুর করছিল, কিন্তু সে মনে সাহস সঞ্চয় করল। ধীরে ধীরে সে শ্মশানের দিকে এগোতে থাকল। কারো চোখে পড়ে গেলে পুরো ব্যাপারটাই পণ্ড হয়ে যাবে।

অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে তার দৃষ্টিটা মাঝেমধ্যে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, তবুও নয়ন থামছে না। শ্মশানের কাছে এসে সে চলার গতিটা কমিয়ে দিল। একটা গাছের আড়ালে এসে দাঁড়াল। সেখান থেকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে সাধুবাবার উপস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করল। ওই, ওইতো দূরে একটা ছাউনির তলায় ধুনি জ্বালিয়ে শয়তানটা বসে রয়েছে। নাহ, এতো দূর থেকে কিছু করা যাবে না। আরেকটু কাছে যেতে হবে। আশপাশে একটু ঝোপঝাড় আছে, তার আড়াল দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করা যাক। প্রায় সে ছাউনিটার কাছে এসে পড়েছে, হঠাৎ দেখল সাধুবাবা ছাউনিতে নেই। গেল কোথায় লোকটা?

কড়কড় কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ল। এতটাই আকস্মিক যে নয়ন চমকে উঠল। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। তাকে যেন কতগুলো ছায়ামূর্তি ঘিরে ফেলছে চারদিক থেকে। গোঙানির মত শব্দটা যেন তারাই করছিল। আরেকটু কাছে আসতে বুঝতে পারল তাকে ঘিরে ধরছে কতগুলো পচাগলা মৃতদেহ। পাগুলো যেন তারা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটছে। প্রত্যেকের ডান হাতে তাদের মুণ্ডুগুলো ঝুলছে। সেগুলো যেন বিস্ফারিত চোখ মেলে নয়নের দিকে চেয়ে আছে। কি চায় ওগুলো? 

আচমকা নয়নের সামনে আবির্ভূত হল সাধুবাবা। জলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “এবার তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। একদম মৃত্যুর মুখে এসে পড়েছিস তুই!“

নয়নের মুখে কথা সরছে না।

“তুই আমার অমরত্বের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছিস। তোর সঙ্গে মোড়লও ছিল। ওকে তো আমি নিশি বানিয়েইছি। তোকেও বানাব।“

নয়ন কোনরকমে তার পিঠে লুকিয়ে রাখা ভাঙা ত্রিশূলটা অনুভব করল। সময় এসে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। সাধুবাবা তার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেই সে প্রানপনে ত্রিশূলটা বার করে সাধুবাবার বুক লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই যেন কড় কড়াত শব্দে আরেকটা বাজ পড়ল। চারদিক যেন রুপোলী আলোয় ভেসে গেল মুহূর্তের জন্য। সেই আলোয় ক্ষণিকের জন্য নয়ন দেখল সাধুবাবা বুকে বিঁধে থাকা ত্রিশূলটা চেপে ধরে চিত হয়ে পড়ে গেল, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ভেজা মাটিকে আরও সিক্ত করে দিচ্ছে। তাকে ঘিরে ফেলেছিল যে ভয়াবহ মূর্তিগুলো, সেগুলো যেন আবছা হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। নয়ন জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল।

কে যেন তাকে নাম ধরে ডাকছে। নয়ন আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তাকে ঘিরে গ্রামের প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার একেবারে কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বসন্তকাকা, তার ঘরের কটা বাড়ি পরেই থাকে, তাকে ছেলের মতই ভালোবাসে। বসন্তকাকা বলে উঠল, “তুই আমাদের খুব বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিস। আশেপাশের গ্রামে যত ছেলেপিলে নিখোঁজ হয়েছিল, সব এই সাধুবাবারই কীর্তি। কিভাবে যেন তুক করে ওদের নিয়ে এসে বলি দিত। কি ছাইপাঁশ অমরত্বের ব্রত নিয়েছিল, সেই জন্যই নাকি এসব করত। তোকে ভোরবেলা বাড়িতে না দেখে খুঁজতে খুঁজতে এদিকপানে এসে তোকে এই অবস্থায় পেলাম।“ নয়ন আস্তে আস্তে উঠে বসল। গ্রামের লোকেরা তার নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। শুধু মোড়লের কথাটা মনে পড়তেই নয়নের চোখের কোণায় একটু জল চলে এল।

Thursday 8 November 2018

আমার লেখা দুটি কবিতা।

১) চেষ্টা। #অণুকবিতা

ভুতের গল্প লেখার চেষ্টা আমি করি মাঝে মাঝে
যখনই অল্পবিস্তর সময় পাই সকাল সাঁঝে
প্রশংসা যে সবসময় জোটে তা নয় বটে
তবুও লেখক হিসাবে নাম করার ইচ্ছা আছে।
ফেসবুকেতে পোষ্টাই, ব্লগও লিখি অবসরে
যখন দেখি কমেন্ট বা লাইক, মনটা আনন্দে ভরে
সাহিত্যিক বন্ধুরা উৎসাহ দিতেই থাকে
লেখার চেষ্টা আমি চালিয়েই যাব নিরন্তরে।



২) সাইকেল বিভ্রাট।

বুড়ো বয়েসে কিনেই ফেললাম একটা সাইকেল
এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই সকাল বিকেল
বাজার হাট সবই করি, ছাত্র পড়াতেও ছুটি
বড়ই কাজের জিনিস, এই ভেবে হই উদ্বেল।

একদিন ফিরছিলাম বাড়ি চড়ে সেই সাইকেল
ঘেউ ঘেউ শুনে যেন হয় হার্ট ফেল
ঘিরে ফেলেছে গোটা তিন কুকুরে
যেন কামড়াবেই আমাকে, খতম আমার খেল।

বাধ্য হয়ে জুড়লাম “এই, এই” চিৎকার
টাল সামলাতে না পেরে খেলাম আছাড়
হঠাৎ দেখি একজন উদয় হলেন
জোর ধমকে করলেন কুকুরগুলোকে পগারপার।

সেই থেকে আমি করেছি অঙ্গীকার
অসাবধানে সাইকেল চালাব না আর 
যতই তাড়া থাকুক না কেন
সামনে কুকুর পড়লে সাইকেল থামাব বারবার।

Tuesday 16 October 2018

কাজলদিঘির অপদেবতা।

গ্রামের নাম নিশ্চিন্দিপুর। খুবই সুন্দর একটি গ্রাম, পাহাড়ের কোলে সবুজিমা দিয়ে ঘেরা। গ্রামে চার পাঁচশ লোকের বাস। শান্তিতেই বসবাস করছিল সব, কোন ঝুটঝামেলা নেই। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে গ্রামে শুধু একটাই সমস্যা, আর সেইটা কাজলদিঘি সম্পর্কিত।

এই প্রসঙ্গে কাজলদিঘির ব্যাপারে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। এটি বহু বছর আগে খোঁড়া একটি মনুষ্যসৃষ্ট দিঘি। দিঘির আয়তন বিশাল, এপার থেকে ওপার হতে বেশ সময় লাগে। দিনের বেলা লোকে মাছ ধরে, সাঁতার কাটে, কোন ভয়ের ব্যাপার নেই। কিন্তু রাতের বেলা ওই পানে যাওয়া বারণ। কেন?

শোনা যায়, বহু বছর আগে গ্রামে এক বিধবা মহিলা বাস করত। তার নাম ছিল রেবা। সুতো কেটে, কাপড় সেলাই করে দিন গুজরান করত। খুবই অভাবের মধ্যে সংসার চলত। হঠাৎই একদিন রাতে সে নিখোঁজ হয়ে গেল। পরের দিন সকালে কাজলদিঘিতে তার দেহটা ভেসে ওঠে। শরীরটা জল খেয়ে ফুলে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে বিস্ফারিত। আত্মহত্যা না খুন, কিছুই জানা যায় না। কিছু দিন পর ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল।

এই ঘটনার পর থেকেই কাজলদিঘিতে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে থাকে এলাকার মানুষজনেরা। রাত্রিবেলা স্ত্রীলোকের গলায় কান্নার আওয়াজ অনেকেই নাকি শুনতে পায়। এলাকায় একবার ভুমিকম্প হয়। এলাকায় অন্যান্য যে দিঘিগুলি রয়েছে, সেগুলোর জলে কম্পন তো দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কাজলদিঘির জল যেন এপাশ ওপাশ হচ্ছে। এইরকম আলোড়ন খুব কমই দেখা যায়। অন্য দিঘিগুলোর জল স্থির হয়ে যাবার পরেও যেন কাজলদিঘির জল যেন থির থির করে কাঁপছিল। এলাকার লোকজন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই ঠিক করল যে পাশের গাঁয়ের রামেশ্বর গুণিনের শরণাপন্ন হবে।

রামেশ্বর গুণিন বাকসিদ্ধ এবং তন্ত্রসিদ্ধ গুণিন। চার পাঁচটা গ্রাম মিলিয়ে তার খুব নামডাক। ঝাড়ফুঁক, ভূত তাড়ানো, বাণ মারা, অপদেবতা থেকে মুক্তি, সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। অতএব তাকেই ডাকা হল। সবকিছু শুনে সে কিছুক্ষণ গাঁজায় দম দিয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর “বোম ভোলে! হর হর মহাদেব!” হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, “এখানে নৃমুণ্ডমালিনীর পূজা দিতে হবে। নইলে তোদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।“ সবাই রাজি হল। কিন্তু গুণিন এই সাবধান বাণীও দিল যে পর পর অন্তত তিন বছর এই পূজা চালিয়ে যেতে হবে। কোন বছর যদি পূজা বন্ধ থাকে, তাহলে বিপদ আবার ফিরে আসবে।

রামেশ্বর গুণিনের কথামত ষোড়শ উপচারে শ্মশান বিহারিণী দেবীর পূজার ব্যবস্থা হল। কিন্তু শবদেহের কি ব্যবস্থা হবে? ঠিক হল গ্রামের নিকটবর্তী শ্মশান থেকেই শবদেহ আনা হবে। পর পর দুবছর ঠিকঠাক পূজা সম্পন্ন হল। কিন্তু তৃতীয় বছরে একটা সমস্যা দেখা দিল। শ্মশান যে জমিতে ছিল, সেটা নাকি বিতর্কিত। জমির মালিক নাকি মামলায় জিতে জমির দখল নিয়ে কারখানা না কি করবে। অতএব কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী শ্মশান সরিয়ে নেওয়া হল। এবারে শবদেহ জোগাড় করাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোথাও শবদেহ পাওয়া গেল না। অভিসম্পাত করতে লাগল গুণিন। সেবছর পূজা আর হল না। তারপর একদিন রামেশ্বর গুণিনও ভোজবাজির মত গ্রাম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল, কেন গেল কেউ বলতে পারল না। তাকে সেই গ্রামে আর কেউ কোনদিন দেখতে পায়নি।

সবার মনেই শঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে এল। কাজলদিঘির আশেপাশে রাত্রিবেলা আবার শোনা যেতে লাগল নানারকম পৈশাচিক আর্তনাদ। সবাই জায়গাটা এড়িয়ে চলতে শুরু করল।

মনসুখ পাণ্ডে জন্মসূত্রে বিহারী, কিন্তু বহুবছর ধরে সে নিশ্চিন্দিপুরে বাস করছে। বাজারের কাছে তার একটা পানের দোকান আছে। প্রত্যেকদিনই সন্ধ্যে সন্ধ্যে সে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে, কিন্তু সেদিন একটু বিক্রিবাট্টা ভালো ছিল বলে যেন একটু বেশীই দেরি হয়ে গেল। যাই হোক, দোকানপাট বন্ধ করে সে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। বিক্রি ভালো হওয়াতে বেশ খোশ মেজাজ, একটা দেহাতি গান গুনগুন করতে করতে সে চলতে লাগল।     

মনসুখের বাড়ি ফেরার দুটো পথ আছে। একটা ঘুরপথ, বেশি সময় লাগে, কিন্তু ওই রাস্তায় কাজলদিঘি পড়ে না। আরেকটা কাজলদিঘির গা ঘেঁসেই, সেটা শর্টকাট হয়। মনসুখ ঠিক করল রাত হয়ে গেছে, শর্টকাট রাস্তাই ধরবে। জায়গাটার ইতিহাস তার খেয়ালই ছিল না। তাহলে হয়ত ওই রাস্তাটা সে বেছে নিত না।   



কাজলদিঘির ঠিক ধারেই একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনসুখের যেন মনে হল ফিসফিসিয়ে তার নাম ধরে কেউ ডাকল। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভাবল মনের ভুল। ভুল করে টর্চটাও দোকানে ফেলে এসেছে। পকেটে একটা দেশলাই বাক্স ছিল। বার করে দুএকটা কাঠি জ্বালাল। চারদিকে ভাল করে দেখল। নাহ, কেউ নেই। একটু এগিয়ে আবার সেই ডাক শুনল। এবার নজরটা শ্যাওড়া গাছের ওপর পড়ল। গাছের ওপরদিকের একটি ডালে যেন কেউ বসে আছে। আলো আধারিতে ভালো বুঝতে পারল না। মেয়েমানুষই মনে হল। কিন্তু এতরাতে গাছের ওপর সে কি করছে? একটু ভয়ও পেল, কৌতূহলও হল। দূর থেকেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনি? এত রাতে গাছের উপর কি করছেন?” মূর্তিটার কোন হেলদোল নেই। পা টিপে টিপে আরেকটু এগিয়ে গেল। এইবারে যা দেখল তাতে তার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল।

মনসুখ দেখল গাছের ডালে বসে তার দিকে চেয়ে রয়েছে একটি কঙ্কাল যার গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো। তার নরকরোটির দুটি চোখের গহ্বরে যেন আগুনের গোলা জ্বলজ্বল করছে। কঙ্কালটি যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। বীভৎস দন্তবিকশিত হাসিও যেন একঝলক দেখা গেল। ভয়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে মনসুখের ডান পাটা একটা গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তে যেন নরম কাদার মধ্যে তার পাটা ঢুকে যেতে লাগল। ভর দিয়ে পাটাকে বার করতে গিয়ে কেমনভাবে যেন অপর পাটাও গর্তে গিয়ে পড়ল। গর্তটা যেন একটা সুড়ঙ্গের মত, তার শরীরটাকে আস্তে আস্তে টেনে নিচ্ছে। গায়ে যেন জলের ঝাপটাও লাগছে। তাকে কি কেউ দিঘির নিচে টেনে নিচ্ছে? শরীরে যেন ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে মনসুখ। দম আটকে আসছে। তাকে কেউ যেন সাঁড়াশি দিয়ে পিষে ধরছে। শেষ মুহূর্তে কংকালের বিকট দংষ্ট্রাবিকশিত হাসি যেন দেখতে পেল মনসুখ। জলের উপরিভাগে কিছুক্ষণ আলোড়ন, হয়ত মনসুখেরই ছটপটানির ফলশ্রুতি, তারপর কিছু বুদবুদ ভেসে উঠল। তারপর দিঘির জল একদম স্থির।

পরের দিন সকালে গাঁয়ের মেয়েরা কাজলদিঘির পারে মনসুখের মৃতদেহটা আবিষ্কার করল। মনসুখ একাই থাকত, তাই রাতে তার জন্য কেউ খোঁজখবর করে নি। শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু কেউই কোন উপায় বাতলাতে পারল না এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার। গ্রাম পঞ্চায়েতের সভা ডাকা হল। আলাপ আলোচনার পর স্থির হল, আর কিছুদিন দেখা যাক। তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা আবার ঘটলে ওই দিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দিতে হবে। আপাতত রাত্রিবেলা ওই পথ কেউ যেন কোনভাবেই না মাড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হল।

কথায় আছে, ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না। সতর্ক করে দিলে কি হবে, ক্ষণিকের অসাবধানতায় বড় বিপদ ঘটে যেতেই পারে। গ্রামে চৌধুরীদের বাড়ির ছেলে সাগরেরও ঠিক তাই হল। সাগরের মায়ের এবং তার মাসির এই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। দুজনের শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। গ্রামে ডাক্তার বদ্যির খুব সমস্যা। সামান্য জ্বরজারি হলেই পাশের গাঁয়ে ছুটতে হয়। সাগরের মার একদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। সাগরের বাবা পড়ল মহা চিন্তায়। হঠাৎই তার মনে পড়ল সাগরের মাসির বর অল্প কবিরাজি বিদ্যা জানে, টুকটাক জ্বরজারির চিকিৎসাও করে থাকে। এত রাতে আর সাগরকে পাশের গাঁয়ে না পাঠিয়ে ওই বাড়িতে পাঠানোই সমীচীন হবে। সে সাগরকে ডেকে বলল, “বাবা সাগর, তোর মেসোমশাইয়ের কাছে এক ছুটে চলে যা। মার কথাটা বল। দেখ কিছু ওষুধ পথ্যির ব্যবস্থা দিতে পারে কিনা। আমি ততক্ষণ তোর মার জন্য জলপটির ব্যবস্থা করিগে।“ সাগর মা অন্ত প্রাণ, শুনেই মারল এক দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে খেয়ালই নেই সে কাজলদিঘির কাছে এসে পড়েছে। হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারিদিকে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

তার দিঘির ওপর চোখ গেল। অদ্ভুত একটা নীল নীল আলো খেলে বেড়াচ্ছে। আলেয়া? হবে হয়ত। আচমকা সে মহিলার গলায় এক তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেল। তার গা ছমছম করে উঠল। তাড়াতাড়ি এই জায়গাটা থেকে বেরোতে হবে। এই জায়গাটা অশুভ। কয়েকপা এগিয়েই দেখল সামনে একটা ডোবা। একি? এখানে তো আগে ডোবা ছিল না। অন্যদিকে যেতে গিয়ে আবার কয়েকপা ফেলে দেখে আরেকটা ডোবা। চারদিক যেন ডোবায় ভর্তি হয়ে গেছে। কি যে হচ্ছে, তার বোধগম্য হল না। পায়ে পায়ে কারা তার দিকে এগিয়ে আসছে? খনখনে গলায় কে যেন হেসে উঠল। সাগরের হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চারদিক থেকে নরকঙ্কালের দল তাকে ঘিরে ধরতে আসছে। তার মনের মধ্যে কে যেন আকুলিবিকুলি করে উঠল, “পালা, সাগর, পালা।“ কিন্তু পালাবে কোনদিকে? কঙ্কালের হাত থেকে বাঁচতে হলে তাকে দৌড়াতে হবে। কিন্তু যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই ডোবা। যা থাকে কপালে ভেবে মারল ঝাঁপ সামনের ডোবাটায়। জল একদম কনকনে ঠাণ্ডা। পায়ে যেন লতার মত কি জড়িয়ে যাচ্ছে। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, লতাগুলো যেন সাপের মত কিলবিল করে তার গলার দিকে এগিয়ে আসছে। পিচ্ছিল লতার স্পর্শ তাকে ভয়ার্ত করে তুলল। লতাগুলো তার গলায় চেপে বসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। শেষে এইভাবে তাকে মরতে হবে? তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল মায়ের অসুস্থ মুখের ছবিটা, যাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে এল। অতল জলের গহ্বরের আকর্ষণে যেন সে মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে সাগরের দেহটা দিঘি থেকে উদ্ধার হল। কোনভাবে সে দিঘিতে নেমেছিল আর পায়ে লতা জড়িয়ে যাওয়ায় আর উঠতে পারেনি। রাতেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সে যে এই পথে আসবে, কেউ ভাবেনি আর সাহসও করেনি। গ্রামবাসীরা আর কোন ঝুঁকি নিল না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজলদিঘি মাটি ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হল। এই দিঘির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি।

Saturday 6 October 2018

কুহকিনীর মায়া।

চলন্ত ডাউন বারুইপুর লোকালে বসে কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎই সামনের সিটের কোনার দিকে নজর পড়ল রজতের। একটি মেয়ে বসে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। এমনিতে রজতের চেহারাটা বেশ সুপুরুষ, রাস্তায় চলতে ফিরতে অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু এই ব্যাপারটা যেন একটু অন্যরকম। মেয়েটির চোখে যেন পলক পড়ছে না। চোখ সরিয়ে কিছুক্ষণ কাগজের দিকে মন দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখল একই ব্যাপার। স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি সালওয়ার কামিজ পরে রয়েছে, মাথায় ওড়নাটা হালকা ঢাকা দেওয়া আছে কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে। অপূর্ব সুন্দরী না হলেও একটা আকর্ষণ আছে। কিন্তু চাউনিটা যেন কেমন। গা ছম ছম করে উঠল তার। এরকম অভিজ্ঞতা তার কোনদিনই হয়নি। জোর করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। তার স্টেশন আসাতে নেমেও গেল। একটু অন্যমনস্ক ছিল, অনেক ভিড়ের মধ্যে সেই মেয়েটিও নামল কিনা খেয়াল করতে পারল না। মন থেকে ব্যাপারটাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করল।

কিন্তু পরের দিনও রজতের একই অভিজ্ঞতা হল। মেয়েটি ঠিক তার সামনের সিটে বসে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। ব্যাপারটা কি? মেয়েটি কি তাকে চেনে? তাকে কি কিছু বলতে চায়? ডেকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারে, এমন অস্বস্তিকর ভাবে চেয়ে থাকার মানেটা কি? রজতের মনের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। 

পর পর বেশ কয়েকদিন তার এই অভিজ্ঞতা হয়। অফিসে, বাড়িতে, কাজে, কর্মে সব জায়গায় রজত যেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। এমনিতে সে খুব মিশুকে নয়, কিন্তু অফিসে অনিলই এমন একজন যার সঙ্গে সে নিজের সুখ দুঃখের কথা একটু আধটু ভাগ করে নেয়। একদিন সে বলেই ফেলল কথাটা। 

“জানিস অনিল, প্রত্যেকদিন অফিস থেকে ফেরার ট্রেনে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।“
“সে কি রে? কিরকম শুনি?”
“একটা মেয়ে সামনের সিটে বসে আমার দিকে রোজ তাকিয়ে থাকে।“
“তাই নাকি? তা এতে অদ্ভুত কি আছে? তুই এত সুপুরুষ, হয়ত তোকে ভালো লেগেছে।“
“ব্যাপারটা এতো মজার নয় রে। মেয়েটার চাউনি যেন কেমন। আমার অস্বস্তি লাগে।“
“কেন? কি রকম চাউনি?”
“সে তোকে বলে বোঝানো যাবে না।”
রজত চুপ করে যায়। অনিলও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি আর ঘাঁটায় না, নিজের কাজে মন দেয়।

আরও দুচার দিন এই ভাবে চলে। একদিন ট্রেনটা যেন একটু বেশিই ফাঁকা ছিল। মেয়েটি একদম তার সামনে এসে বসে পড়ল। রজত একটু চমকে উঠল। কিন্তু মনে মনে সে স্থির করল যে আজ সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবেই। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের জড়তাটা কাটিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “শুনুন, কিছু যদি মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”
“হ্যাঁ, বলুন।“
“আপনি কি আমাকে কোনভাবে চেনেন? বা আগে কোথাও দেখেছেন?”
“কই, না তো।“
“তাহলে আপনি......আমার দিকে দেখি রোজই তাকিয়ে থাকেন?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।“
রজত চমকে উঠল। কি বলবে বুঝতে পারল না। একি মেয়েরে বাবা! সেদিন আর কথা এগোল না।


এরপর কয়েকদিন ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে আরও কিছু কথা হল মেয়েটির সঙ্গে। আস্তে আস্তে রজতও সহজভাবে কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে লাগল। ধীরে ধীরে তার অস্বস্তি কাটতে লাগল। যদিও সে কখনো প্রশ্ন করেনি তাকে কেন মেয়েটির খুব ভালো লাগে।

কথায় কথায় অনেককিছুই সে জানতে পারল মেয়েটির সম্বন্ধে। তার নাম মোহিনী, সে একটি সওদাগরী অফিসে রিসেপশনিস্টের কাজ করে। বাবা মা সে ছোট থাকতেই মারা গেছেন, মামাবাড়িতেই মানুষ। বারুইপুরে সে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে কারণ মামাবাড়িতে থাকার জায়গার খুব সমস্যা। মোহিনীও রজতের সম্পর্কে সবই জেনে নিয়েছে। বাবা মার একমাত্র ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা, উজ্জল ভবিষ্যৎ। কোম্পানিতে তার পদোন্নতি চোখে পড়ার মত। তরতরিয়ে উপরে উঠছে। কিছুদিনের মধ্যে রজতেরও মোহিনীকে ভালো লাগতে শুরু করল। 

এইরকম ভাবে চলছে। একদিন হঠাৎ মোহিনীই প্রস্তাবটা দিল, “চল না, একদিন ভিক্টোরিয়া, ময়দান এসব জায়গা ঘুরে আসি।“ রজত দেখল প্রস্তাব মন্দ নয়। প্রেম করার পক্ষে বেশ ভালো জায়গা এগুলো। এক রবিবার ঠিক হল যাওয়া। সময়টা বেশ কাটল দুজনের। ফেরার পথে একটা বেশ নামকরা রেস্তরাঁতে খেয়েও নিল দুজনে। কিন্তু যখন ট্যাক্সি করে ফিরছে সন্ধেবেলা, তখনই রজতের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

সেদিন মনে হয় পূর্ণিমা ছিল, আকাশে চাঁদটা থালার মত ঝলমল করছিল। ট্যাক্সিতে বসে রজত অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে মোহিনীর কোন ছায়া পড়ছে না। আর চাউনিটাও যেন কেমন অস্বাভাবিক। বাড়ি ফিরে সে এই ঘটনাটা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ল। তবে কাউকে কিছু জানাল না।

অনেকদিন ধরেই মোহিনী বায়না করছিল যে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কোথাও আউটিংএ যাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সেদিনের সেই ট্যাক্সির ঘটনা ঘটার পর রজতের খুব একটা উৎসাহ নেই। এদিকে মোহিনীরও প্রচণ্ড জেদ, যেতেই হবে। অগত্যা রজত রাজি হয়েই গেল। যদিও মনের ভিতরটা খচখচ করতেই লাগল।

দুজনে মিলে মন্দারমণিই ঠিক করল। বেশ নিরিবিলি জায়গা, বেড়ানোর পক্ষে বেশ ভালো। মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনেই রওনা দিল। ট্রেনে মন্দারমণি যেতে গেলে কাঁথিতে নামতে হয়, সেখান থেকে আবার গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বেশ ভালো একটা হোটেলে বুকিং করাই ছিল, সি ফেসিং একটা ঘর পাওয়া গেল। দিনের বেলা বেশ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে কেটে গেল সময়টা। কিন্তু রাত্রিবেলা যে ঘটনাটা ঘটল সেটা যেকোনো মানুষের মনকে বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুজনেই হোটেলে বেডরুমে এসে শুয়েছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রত্যেকদিনই রজতের বই পড়া অভ্যেস। এদিন সে ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” পড়ছিল। হঠাৎই মোহিনী তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস কর?”
“নাহ, তবে পড়তে ভালো লাগে এই আর কি।“
“ওঃ।“
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার প্রশ্ন করল, “যদি তুমি সামনাসামনি ভ্যাম্পায়ার দেখো, তোমার কেমন লাগবে?”
রজত চমকে উঠল। এই রকম প্রশ্ন সে আশা করেনি। মোহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখল কেমন যেন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরের বাইরেও আবহাওয়াটাও যেন পরিবর্তিত হচ্ছে। ঠাণ্ডা একটা হিমেল হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। মোহিনী হঠাৎই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে “যত্তসব বাজে কথা” বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল রজত। বইটা রেখে আলোটা নিভিয়ে দিল। আজ আর তার কিছু ভালো লাগছেনা।

কিন্তু মাঝরাতে যখন মোহিনী তাকে কাছে টেনে নিল, তার মধ্যে কামনার প্রবৃত্তি জেগে উঠল। সবই ঠিকঠাক ছিল, শুধু মোহিনীর শরীরটা তার যেন অসম্ভব শীতল মনে হল। এই প্রথম তাদের দৈহিক সম্পর্ক, কিন্তু রজত যেন সম্পূর্ণভাবে তা উপভোগ করতে পারল না। নিজেকে তার যেন একটা যন্ত্র বলে মনে হল।

মিলন শেষে রজত এলিয়ে পড়েছিল। শরীরটা যেন নিস্তেজ। হঠাৎই দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজাটা খুলে গেল। চমকে উঠে পাশ ফিরতেই দেখল মোহিনী পাশে নেই। গেল কোথায়? হঠাৎই বারান্দার দিকে নজর গেল। বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে? মোহিনী না? কিন্ত এ কোন মোহিনী? তার দেহটা যেন স্বচ্ছ, তার মধ্যে দিয়ে দুরের আকাশ, চিকচিকে তারা দেখা যাচ্ছে। মোহিনী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। কিন্তু রজত কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিন্তু মন্ত্রের মত যেন তাকে মোহিনী টানছে। সে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোহিনী তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু এই জড়ানো যেন প্রেমিকার আলিঙ্গন নয়। এ যেন অজগরের আলিঙ্গন। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সে চিৎকার করতে গেল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না। তার গোটা শরীরটা যেন বরফ জলে ডুবে যাচ্ছে। মোহিনীর লিপস্টিকে রাঙা সুন্দর দুটি ঠোঁটের পাশ দিয়ে ভয়াল একজোড়া ছুঁচলো দাঁত বেরিয়ে আসছে কেন? এরকম কি কোন স্বাভাবিক মানুষের হয়? এক ঝাঁকুনি দিয়ে রজতের গলাটা তার দিকে টেনে নিয়ে মোহিনী দাঁত বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তা দিয়ে মোহিনী যেন কতদিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। রজতের শরীরটা যেন খাঁচায় পোরা পাখির মত ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। তাকে পালকের মত তুলে নিয়ে হোটেলের তিনতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মোহিনী। সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজেই হয়ত নিচে পড়ার আওয়াজটা চাপা পড়ে গেল। জিঘাংসা ভরা দৃষ্টিতে নিচে একবার তাকিয়েই মোহিনী ধোঁয়ার মত বাতাসে মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে হোটেলের এক কর্মচারী রজতের মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। চোখদুটো যেন ভয়ংকর কিছু দেখে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। শরীরটা যেন রক্তশূন্য কাঠের মত পড়ে রয়েছে। কেউ যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। গলার বাঁদিকে দুটো গোল সমান্তরাল ক্ষতচিহ্ন। আস্তে আস্তে তার চারপাশের ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। পুলিশকে খবর দিতে হবে।

Sunday 23 September 2018

বিভূতিভূষণের জীবনের সত্য ঘটনা।

"বিভূতিভূষণের বৈঠকি গপ্পো" থেকে প্রাপ্ত। একটু ছোট করে লিখলাম। এইটা ঘাটশিলার কাছে সুবর্ণরেখা নদীর পারে ঘটেছিল। বিভূতিভূষণ পুজোর ছুটিতে ঘাটশিলা ভ্রমণে গেছিলেন। প্রায়ই সেখানে যেতেন কারণ তাঁর ছোট ভাই নুটুবিহারী সেখানে হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। বিভূতিভূষণ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক আর ঘাটশিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা কে না জানে। আর উনি ছিলেন অত্যন্ত আলাপী মানুষ, অল্প সময়ের মধ্যেই লোকজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলতেন।

এমনি এক সন্ধ্যায় সবান্ধব বেড়াতে বেড়িয়েছিলেন। দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেল, তাঁর বাড়ি ফেরার নাম নেই। বাড়ির লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ল। রাত দশটা বেজে গেল, তাই বাধ্য হয়েই ভাই নুটুবিহারী খোঁজ করতে বেরলেন। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারল না। হঠাৎই বিভূতিভূষণ সবার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বাড়ি ফিরলেন। দুজন বন্ধু তাকে আলো নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। সবারই প্রচণ্ড কৌতূহল, কি হয়েছিল। খেতে বসে ঘটনাটা বর্ণনা করলেন।   

হাঁটতে হাঁটতে সুবর্ণরেখার ধার ধরে অনেকদুর চলে গেছিলেন। পূর্ণিমার রাত। শ্মশানঘাটের কাছে পৌঁছে গেছেন সবাই। হঠাৎ করে তাঁর মনে হল যেন দূরে একটা খাটিয়ায় শায়িত শবদেহ দেখতে পেলেন। অথচ তাঁর সঙ্গে যারা ছিলেন তারা তা দেখতে পেলেন না এবং বিভূতিভূষণের কথা বিশ্বাসও করলেন না। মনের ভুল বলে উড়িয়েই দিলেন। শুধু তাই নয়, বাড়ি ফেরার তাগাদা লাগালেন। রাত্রিবেলা শ্মশানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভাল, এই যুক্তিও দিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বিভূতিভূষণের অলৌকিক ব্যাপার জানার অদম্য কৌতূহল ছিল। এত সহজে তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন। কিন্তু সঙ্গীরা তাকে একা কিছুতেই ছাড়বেন না। অগত্যা তাদের পিছন পিছন সাঁওতাল পাড়ার কাছে এসে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সঙ্গীদের বললেন যে লোকালয় প্রায় এসেই গেছে, তারা এগিয়ে যান, তিনি একটু পরে যাচ্ছেন। সঙ্গীরা রাজি হলে তিনি লম্বা লম্বা পায়ে আবার শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দেখলেন সত্যিই একটা শবদেহ সমেত খাটিয়া পড়ে রয়েছে। কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে দেখলেন শবদেহটা একটা ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে ঢাকা আছে। আশেপাশে কেউ নেই। শবযাত্রীরা এদিক ওদিক কোথাও গেছে ভেবে হাঁকডাক করলেন, কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। হঠাৎ তাঁকে কেউ যেন বলল "যা না...... কাঁথাটা সরিয়ে দেখ।" বিভূতিভূষণ শিউড়ে উঠলেন। পিছন দিকে তাকালেন কিন্তু কণ্ঠস্বরের অধিকারীকে দেখতে পেলেন না। ভাবছেন পালাবেন কিনা। কিন্তু কৌতূহল সম্বরণও করতে পারলেন না। আবার সেই রহস্যজনক কণ্ঠস্বর, "যা, যা না, এগিয়ে যা...... কাঁথাটা সরিয়ে দেখ।" তাকে যেন কোন অলৌকিক শক্তি শবদেহটার দিকে টানছে। কাঁথাটা সরিয়ে দেখলেন একজন বয়স্ক পুরুষের মৃতদেহ। বড় বড় চোখ মেলে তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছে মনে হল। আরও কাছে মুখ আনতেই ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। মৃতদেহটার মুখাবয়ব একদম তাঁর মতন - অবিকল এক। যেন আয়নায় মুখ দেখছেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বাড়ী ফিরে এলেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি পরলোক গমন করেন।

(সংগৃহীত)