নামটি তার নয়ন। যদিও তাকে কারো নয়নের মণি বলা যায় না, কিন্তু গ্রামসুদ্ধ লোক তাকে ভালোবাসে। অনেক ছোটবেলাতেই মা বাবাকে হারিয়েছে সে। গ্রামের লোকেরাই তার দেখভাল করেছে। লেখাপড়া তার খুব বেশিদূর হয়নি। কোনরকমে টেনেটুনে ক্লাস এইট। গ্রামে এর ওর ফাইফরমাস খাটে, দুপয়সা যা রোজগার হয়, চলে যায়। গ্রামের লোকেরাই একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
গ্রামের নাম গোবিন্দপুর (কাল্পনিক)। পশ্চিমবঙ্গের কোন একটি জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। নয়ন থাকে একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে। আজ থেকে বহু বছর আগে ওই কুঁড়েঘরে এক তান্ত্রিক এসে আশ্রয় গেড়েছিল। তান্ত্রিকেরা সাধারণত একজায়গায় খুব বেশিদিন থাকে না। একদিন সেও গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেল। তাই গ্রামের লোকেরা নয়নকে বলল, “কুঁড়েটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে, তুইই থাক ওখানে। তোর জন্য আলাদা ঘর করে দেওয়া অনেক খরচার ব্যাপার। পরে দেখা যাবে।“ নয়ন তাতেই রাজি হল। অন্ন বস্ত্রের জন্য তার চিন্তা নেই, বাসস্থানও সে পেয়ে গেল। গ্রামের লোকেরাই তার বিছানা, তোষক ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিল।
নয়নের বহুদিনের অভ্যাস অবসর সময়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো। এই করতে গিয়ে সে অনেক কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। তবে কোনটাই খুব ভীতিপ্রদ নয়।
একদিন সন্ধ্যেবেলা নয়নের হাতে কোন কাজ ছিল না। সে মাঝে মাঝেই ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের শ্মশানের কাছে চলে যেত। অন্য লোকেরা যেখানে শ্মশানকে এড়িয়ে চলে, সেখানে নয়ন নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। নির্জনতা যেন তাকে আকর্ষণ করত।
সে ঘুরতে ঘুরতে শ্মশানের কাছে এসে লক্ষ্য করল, ভিতরে একটা ধুনি জ্বলছে। এখন এইখানে কে ধুনি জ্বালাবে? আশেপাশে কাউকে তো চোখে পড়ছে না। আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক। একটা বড় গাছের আড়াল থেকে সে দেখল, ধুনির পাশে গেরুয়া বসন পরিহিত কে যেন বসে আছে। ধুনির ধোঁয়ায় যেন একটা আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ধুনির পাশে বসে থাকা লোকটাকে একজন সাধুবাবা বলেই মনে হল তার। কিন্তু সাধুবাবার হাতে ওটা কি? ভালো বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু ঠাওর করে দেখতেই চমকে উঠল নয়ন। ওটা তো একটা কাটা মুণ্ডু, যার গলার কাছ দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত সাধুবাবার পায়ের কাছে একটা কঙ্কালের খুলির মধ্যে পড়ছে। সাধুবাবা আবার বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়ছেন। ভয়ে নয়নের গলা শুকিয়ে গেল।
খসখস পায়ের শব্দ হওয়াতেই মনে হয় সাধুবাবা নয়নের উপস্থিতি টের পেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নয়ন ভয়ে চুপ করে রইল, নট নড়নচড়ন না কিছু। কিন্তু সাধুবাবা তাকে কিছু বললেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নয়ন দে দৌড়, দেখতে দেখতে ত্রিসীমানা পার।
গ্রামে পৌঁছে নয়ন কাউকে কিছুই বলল না। কিন্তু তার মনটা খচখচ করতেই থাকল। এত বড় একটা বীভৎস ব্যাপার, চুপ করে থাকাটাও তো উচিত হবে না। নয়ন ভাবল কয়েকদিন অপেক্ষা করা যাক।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। গ্রামের মোড়লের কাছে খবর পৌঁছল যে আশেপাশের গ্রাম থেকে নাকি বেশ কয়েকটি বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে। চিন্তায় পড়ে গেল মোড়ল। নয়নও ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। সে খবরটা আর চেপে রাখতে পারল না। বলেই দিল মোড়লকে।
মোড়ল ব্যাপারটা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “যা দেখেছিস, ঠিক দেখেছিস? মনের ভুল নয়তো?” নয়ন বলল, “না গো মোড়লমশাই, আমি ঠিকই দেখেছি।“
মোড়ল বলল, ”ঠিক আছে, আরেকদিন তোর সঙ্গে আমি চুপিচুপি শ্মশানে যাব। দেখি ব্যাপারটা কি হচ্ছে। তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করব।“ নয়ন রাজি হল। একা যেতে হলে হয়ত সাহস পেত না, কিন্তু সঙ্গে মোড়ল থাকবে।
এই কথামত একদিন সন্ধ্যেবেলা নয়ন মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে সাধুবাবার কাণ্ডকারখানা সব দেখে এল। সেদিন সাধুবাবা শবসাধনা করছিলেন। পাশে কারণবারিও রাখা ছিল। চারিদিকে একটা ভৌতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। তাদের দুজনের উপস্থিতি তিনি টের পাননি বা টের পেলেও তাদের বুঝতে দেননি। তার মনসংযোগ এতটাই বেশি ছিল।
দুজনেই চুপচাপ বাড়ি ফিরে এল। ফেরার পথে মোড়ল তাকে সাবধান করল, “এখনই কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। ভেবে দেখি কি করা যায়।“
রাত তখন বেশ গভীর। মোড়ল নিজের একচালা ঘরে শুয়ে রয়েছে। স্ত্রী অল্পবয়সে বিয়োগ হওয়াতে একাই থাকে, ছেলেমেয়ে হয়নি। সাধুবাবার এই কাণ্ডকারখানা নিয়ে একটু বেশীই চিন্তিত ছিল বলে ঘুম আসতে দেরিই হচ্ছিল। চোখটা যেন একটু বুজে এসেছে, মনে হল অস্ফুট স্বরে কেউ তার নাম ধরে ডাকল। গলাটা যেন চেনাচেনা লাগল তার। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। ওই আবার! কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। আরে! এতো তার স্ত্রী সরমার গলা। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সরমা তো কতদিন আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে কি অন্য কেউ? মোড়ল আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজাটা খুলে ফেলল।
দরজাটা খুলে প্রথমে পরিষ্কার কিছু দেখতে পেল না। দূরে মনে হল আবছা একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে পা টিপে এগিয়ে চলল। সে যত এগোচ্ছে, ছায়ামূর্তিটাও যেন আরও দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। সে যেন এই ডাকে সম্মোহিত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে মোড়লের দেহটা জঙ্গলের গহীনে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দূরে যেন একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ।
পরের দিন গ্রামের লোকেরা দেখল মোড়লের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, মোড়ল বেপাত্তা। হইহই রব পড়ে গেল। একেকজনের একেকরকম মতামত। শুধু নয়নই চুপ করে রইল। সে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। তবুও সে কাউকে কিছু জানাল না। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে......
মোড়ল নিখোঁজ হবার পর এক সপ্তাহ মত কেটে গেছে। তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। সেদিন রাতের কথা। নয়ন শুয়ে রয়েছে কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মোড়লের কথাটা তার বারবার মনে আসছে। তাকে খুবই ভালবাসত, নিজের সন্তানের মতই দেখত। তার যেকোনো সমস্যার সমাধান মুহূর্তের মধ্যে করে দিত। তার কি হল? তাকে কি সাধুবাবা খুন করেছে? কেনই বা তা করতে যাবে? মোড়লের কোন শত্রু ছিল বলে তার মনে পড়ল না। এমনি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু যেন ঘুমঘুম ভাব এসেছে, হঠাৎই যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকল।
“এই নয়ন!”
চমকে উঠল সে। আরে! এতো পরিষ্কার মোড়লের গলা। তবে কি মোড়ল ফিরে এসেছে? কিন্তু এতদিন ধরে যে লোকটা নিখোঁজ সে হঠাৎ তার কাছে এসেছে কেন? সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।
“এই নয়ন, বাইরে আয়, আমি মোড়লমশাই বলছি!”
নয়নকে কেমন যেন একটা অজানা ভয় গ্রাস করতে থাকে। হঠাৎই তার নিশির ডাকের কথা মনে পড়ে যায়। এ নিশ্চয় নিশির ডাক হবে। ওই সাধুবাবারই কীর্তিকলাপ এটা। সে নিশ্চয় নিশির ডাক ব্যবহার করে কোনভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এবারে তার মনে হল বহু বছর আগে যে তান্ত্রিক এ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছিল এই সাধুবাবা সে ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তার ফাঁদে পা দিয়েই নিশ্চয় মোড়ল প্রাণ হারিয়েছে এবং নিশিতে রুপান্তরিত হয়েছে। এবারে তার পালা। না, সে কিছুতেই এই ডাকে সাড়া দেবে না। মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়।
“এই নয়ন, বাইরে আসবি তো, আমি মোড়লমশাই বলছি!”
আবার সেই ডাক! নয়ন উঠল না। আর ডাকাডাকি শোনা গেল না। বাকি রাতটা নয়ন জেগেই কাটিয়ে দিল।
পরের দিন সকালে নয়ন একটা খুব গুরুতর সিদ্ধান্ত নিল। সাধুবাবাকে সে নিজের হাতে শেষ করবে। হ্যাঁ, নিজের হাতে। এর জন্যে হয়ত তাকে খুব বড় একটা ঝুঁকি নিতে হবে, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। মনে মনে ঠিক করে ফেলল কি করবে। গ্রামের পুরানো ভাঙা কালীমন্দির থেকে ত্রিশূলটা জোগাড় করতে হবে। চুপিসারে কাজটা সারতে হবে, কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়।
দুপুরের দিকে গ্রামের রাস্তা মোটামুটি নির্জন হয়ে যায়। কাউকে জানান না দিয়ে নয়ন ত্রিশূলটা জোগাড় করে ফেলল। মনে মনে মা কালীর আশীর্বাদও কামনা করল।
সেই রাতটা ছিল বর্ষাবাদলের রাত। নয়নের বুকটা দুরদুর করছিল, কিন্তু সে মনে সাহস সঞ্চয় করল। ধীরে ধীরে সে শ্মশানের দিকে এগোতে থাকল। কারো চোখে পড়ে গেলে পুরো ব্যাপারটাই পণ্ড হয়ে যাবে।
অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে তার দৃষ্টিটা মাঝেমধ্যে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, তবুও নয়ন থামছে না। শ্মশানের কাছে এসে সে চলার গতিটা কমিয়ে দিল। একটা গাছের আড়ালে এসে দাঁড়াল। সেখান থেকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে সাধুবাবার উপস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করল। ওই, ওইতো দূরে একটা ছাউনির তলায় ধুনি জ্বালিয়ে শয়তানটা বসে রয়েছে। নাহ, এতো দূর থেকে কিছু করা যাবে না। আরেকটু কাছে যেতে হবে। আশপাশে একটু ঝোপঝাড় আছে, তার আড়াল দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করা যাক। প্রায় সে ছাউনিটার কাছে এসে পড়েছে, হঠাৎ দেখল সাধুবাবা ছাউনিতে নেই। গেল কোথায় লোকটা?
কড়কড় কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ল। এতটাই আকস্মিক যে নয়ন চমকে উঠল। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। তাকে যেন কতগুলো ছায়ামূর্তি ঘিরে ফেলছে চারদিক থেকে। গোঙানির মত শব্দটা যেন তারাই করছিল। আরেকটু কাছে আসতে বুঝতে পারল তাকে ঘিরে ধরছে কতগুলো পচাগলা মৃতদেহ। পাগুলো যেন তারা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটছে। প্রত্যেকের ডান হাতে তাদের মুণ্ডুগুলো ঝুলছে। সেগুলো যেন বিস্ফারিত চোখ মেলে নয়নের দিকে চেয়ে আছে। কি চায় ওগুলো?
আচমকা নয়নের সামনে আবির্ভূত হল সাধুবাবা। জলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “এবার তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। একদম মৃত্যুর মুখে এসে পড়েছিস তুই!“
নয়নের মুখে কথা সরছে না।
“তুই আমার অমরত্বের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছিস। তোর সঙ্গে মোড়লও ছিল। ওকে তো আমি নিশি বানিয়েইছি। তোকেও বানাব।“
নয়ন কোনরকমে তার পিঠে লুকিয়ে রাখা ভাঙা ত্রিশূলটা অনুভব করল। সময় এসে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। সাধুবাবা তার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেই সে প্রানপনে ত্রিশূলটা বার করে সাধুবাবার বুক লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই যেন কড় কড়াত শব্দে আরেকটা বাজ পড়ল। চারদিক যেন রুপোলী আলোয় ভেসে গেল মুহূর্তের জন্য। সেই আলোয় ক্ষণিকের জন্য নয়ন দেখল সাধুবাবা বুকে বিঁধে থাকা ত্রিশূলটা চেপে ধরে চিত হয়ে পড়ে গেল, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ভেজা মাটিকে আরও সিক্ত করে দিচ্ছে। তাকে ঘিরে ফেলেছিল যে ভয়াবহ মূর্তিগুলো, সেগুলো যেন আবছা হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। নয়ন জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
কে যেন তাকে নাম ধরে ডাকছে। নয়ন আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তাকে ঘিরে গ্রামের প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার একেবারে কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বসন্তকাকা, তার ঘরের কটা বাড়ি পরেই থাকে, তাকে ছেলের মতই ভালোবাসে। বসন্তকাকা বলে উঠল, “তুই আমাদের খুব বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিস। আশেপাশের গ্রামে যত ছেলেপিলে নিখোঁজ হয়েছিল, সব এই সাধুবাবারই কীর্তি। কিভাবে যেন তুক করে ওদের নিয়ে এসে বলি দিত। কি ছাইপাঁশ অমরত্বের ব্রত নিয়েছিল, সেই জন্যই নাকি এসব করত। তোকে ভোরবেলা বাড়িতে না দেখে খুঁজতে খুঁজতে এদিকপানে এসে তোকে এই অবস্থায় পেলাম।“ নয়ন আস্তে আস্তে উঠে বসল। গ্রামের লোকেরা তার নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। শুধু মোড়লের কথাটা মনে পড়তেই নয়নের চোখের কোণায় একটু জল চলে এল।